‘পতন’ হয়েছে ব্রহ্মবান্ধবের, সেই সূত্রেই জন্ম নিল রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস

সাংবাদিকতাকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন তিনি। ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন এক তীব্র আন্দোলন। আবার, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের আশ্রমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কাজে প্রধানতম সহযোগী ছিলেন তিনি। বিদেশি শিক্ষার প্রতি ছিল প্রবল রাগ। ভারতীয় ধর্ম ও সমাজচেতনার আশ্চর্য মেলবন্ধনে স্বপ্ন দেখেছিলেন নতুন দেশের। অথচ, সার্ধ জন্মশতবর্ষ পার করেও ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের (Brahmabandhav Upadhyay) জীবন ও সাহিত্যচর্চাকে একপ্রকার উদাসীনতা ছাড়া ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি কিছুই। সংকলিত ও সরক্ষিত করা যায়নি তাঁর অনেক লেখাপত্র।

ব্রহ্মব্রান্ধব উপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৬১ সালে। আসল নাম ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেনের প্রভাবে গ্রহণ করেন ব্রাহ্মধর্ম। কিছুদিনের মধ্যেই কাকা কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্য রোমান পাদরিদের সংস্পর্শে এসে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেন তিনি। প্রথমে প্রোটেস্টান্ট থাকলেও, পরে অনুরক্ত হয়ে পড়েন রোমান ক্যাথলিকদের প্রতি। পরিবর্তন করেন জীবনযাত্রা, সন্ন্যাসীবেশ ধারণ করে যুক্ত হন বাংলার বাইরে মঠ ও আশ্রম প্রতিষ্ঠার কাজে। সময়টা উনিশ শতকের শেষ লগ্ন। ঠিক তখনই এদেশের বুকে জ্বলে ওঠে এক স্ফুলিঙ্গ, যাঁর নাম স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর আদর্শে ১৯০১ সালে ফের ধর্ম পরিবর্তন করে নতুন নাম নিলেন ব্রহ্মবান্ধব। স্বামীজির মৃত্যুর পর সামান্য কিছু টাকা সম্বল করে বেদান্ত ধর্ম প্রচারের জন্য পাড়ি দিলেন বিদেশে। শুরু হল নতুন যাত্রা। এতবার ধর্ম পরিবর্তনের কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা না দিলেও, বৃহত্তর মানবতার স্বার্থে যা প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে, তাকেই গ্রহণ করেছেন তিনি। সেই দিকেই ইঙ্গিত করে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, “উপাধ্যায়জী আজও আমাদের দেশে মিসআন্ডারস্টুড হইয়া আছেন।”

ব্রহ্মবান্ধবের জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। তাঁর সিমলা স্ট্রিটের ‘আয়তন’ স্কুলে প্রায়ই আসতেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর আহ্বান করলেন শান্তিনিকেতনের আশ্রমের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য। তিনি ছিলেন ব্রহ্মাচর্য আশ্রমের প্রধান উৎসাহদাতা। বিদ্যালয়ের সূচনাকালের ১০ জন ছাত্রের মধ্যে ৮ জনকে নিয়ে আসেন ব্রহ্মবান্ধব। বাকি দুজন ছিলেন রবীন্দ্রপুত্র—রথীন্দ্র ও শমীন্দ্র। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায় তিনি ‘তেজস্বী, নির্ভীক, ত্যাগী, বহুশ্রুত ও অসামান্য প্রতিভাশালী ব্যক্তি’। তবে তাঁকে বেশিদিন বেঁধে রাখতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। স্থায়ী কোনো পদেও ছিলেন না ব্রহ্মবান্ধব। ফলে মুক্ত পাখির মতো প্রায়ই বেরিয়ে পড়তেন দেশভ্রমণে। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “ব্রহ্মবান্ধব যদি আশ্রমের দায়িত্ব বহন না করতেন তাহলে কাজ চালানো একেবারে অসাধ্য হত।” অবশ্য বিভিন্ন কারণে পরে শান্তিনিকেতনের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় ব্রহ্মবান্ধবের। বিচ্ছেদের আগে করে গেছিলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তিনিই প্রথম রবীন্দ্রনাথকে উপাধি দেন ‘গুরুদেব’। 

তার কিছু বছর আগেই সিমলাতে লর্ড কার্জনের পৌরোহিত্যে একটি শিক্ষা সম্মেলন হয়। যেখানে ইংরেজ পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষাব্যবস্থার আশু সংস্কারের নির্দেশ দেওয়া হয়। বিরোধিতা করেন ব্রহ্মবান্ধব। ভারতের আত্মাকে মেরে দেশের শিক্ষার উন্নতি তিনি চান না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর কাছে ছিল ‘গোলদিঘির গোলামখানা’। জাতীয় কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন আজীবন। লিখেছেন প্রচুর প্রবন্ধ, কলমই ছিল তাঁর প্রধানতম অস্ত্র। সেই সূত্রেই ১৯০৪ সালে প্রকাশ করেন ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকা। বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতীয় ভাবনা উজ্জীবনের মন্ত্রোচ্চারণ দিয়ে যাত্রা শুরু তার। ‘সন্ধ্যা’-র মন্ত্র ছিল, “দুঃসময় পড়িলে লোকে বলে এই ত কলির সন্ধ্যা অর্থাৎ কালরাত্রির কেবলমাত্র আরম্ভ হইয়াছে। অন্ধকার ঘুচিয়া গিয়া সুপ্রভাত এখন অনেক বিলম্ব।” সেই নতুন দিনের আশায় ‘সন্ধ্যা’ যেন আগুন জ্বালিয়ে দিল চারদিকে। বিষ নজরে তাকাল ইংরেজও। ১৯০৭ সালে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার কর ইংরেজ সরকার। আদালতে তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, এই ব্রিটিশ কর্তৃত্ব তিনি মানেন না। মামলা চলাকালীনই ধনুষ্টংকার রোগে জীবনাবসান হয় তাঁর।

আরও পড়ুন
স্বাধীনতার পর, সরকারের দেওয়া পেনশন নিতেও অস্বীকার করেন বীণা

তার তিন বছর পরে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসটি। ব্রহ্মবান্ধবের গ্রামভ্রমণ, পোশাকের বর্ণনা, ধর্ম পরিবর্তনের জন্য প্রায়শ্চিত্ত অনেক ঘটনাই যেন মিলে যায় উপন্যাসের সঙ্গে। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আরেকটি উপন্যাস, ‘চার অধ্যায়’। বিতর্কও কম হয়নি সেই সময়ে। সশস্ত্র বিপ্লবীদের শুধুমাত্র ঋণাত্মক করেই দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, এই ছিল অভিযোগ। উপন্যাসের ‘সূচনা’-য় কিছু স্মৃতিকথা ছিল রবীন্দ্রনাথের। একদিন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এলেন ব্রহ্মবান্ধব, তখন তিনি ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার বৈপ্লবিক কাজে জড়িয়ে পড়েছেন সম্পূর্ণভাবে। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, “আমার খুব পতন হয়েছে।” এক বেদান্ত পণ্ডিত থেকে বিপ্লবের কারিগরের এই পরিবর্তনে সন্তুষ্ট হতে পারেননি রবীন্দ্রনাথও। তাঁর মনে হয়েছিল, যেন নষ্ট হয়ে গেল অসংখ্য সম্ভাবনা। নিষ্কৃতির পথ নেই আর কোনো। সেই চেতনা কি কাজ করেছিল ব্রহ্মবান্ধবের মধ্যেও? নাকি, ধর্ম পরিবর্তনের পুরনো অভ্যাসের মতো উন্মাদনা থেকেই জড়িয়ে পড়েছিলেন সক্রিয় রাজনীতিতে। তাই হয়তো উচ্চারণ করেছিলেন ‘পতন’-এর মতো শব্দ। ফলে ‘চার অধ্যায়’-এর অতীনের মধ্যে ব্রহ্মবান্ধবের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া আশ্চর্যজনক কিছু নয়। 

আরও পড়ুন
দেশের জন্য লড়েও ছাড়তে হয়েছিল ভিটে, দিনাজপুরের ‘অবজ্ঞাত’ স্বাধীনতা সংগ্রামীর গল্প

সব মিলিয়ে ‘মিসআন্ডারস্টুড’ হয়ে রইলেন তিনি। নিজের কাজকে সঠিক নিশানায় পৌঁছে দিতে পারেননি বিভিন্ন কারণে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থেকে যায় তাঁর কয়েকটি কথা, “আমি আবার জন্মাব, আবার এই দেশে আসব, আবার দেশের জন্য কার্য করিব।” এই সাহস আর স্পর্ধা ছিল বলেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন সমস্ত বিধিনিষেধ। জীবনের বহু খাতে বিভ্রান্ত হয়ে পেয়েছিলেন ট্রাজেডির নায়কের সম্মান।

Powered by Froala Editor