রাঢ়বঙ্গের মাটিতে ‘দেশ’-এর খোঁজ এবং বহুমতের তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Tarashankar Bandyopadhyay) প্রসঙ্গে একটি বহুল প্রচারিত শব্দবন্ধ বারবার ফিরে আসে। তিনি ‘রাঢ় বাংলার কথাসাহিত্যিক’। বাস্তবিক ‘কবি’, ‘রাধা’, ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’, ‘হাসুঁলী বাঁকের উপকথা’ প্রভৃতি উপন্যাসে তিনি প্রবেশ করেছেন রাঢ় বঙ্গের লোকজীবন, সংস্কার, মিথের অভ্যন্তরে। বীরভূমের অচেনা বিস্তৃত প্রান্তর হয়ে উঠেছে উপন্যাসের মূল চরিত্র। কিন্তু তাতেই কি তারাশঙ্করের বহুমুখী জীবন ও সাহিত্যকে একটা ‘খোপ’-এ ভরে ফেলা উচিৎ? রাঢ়ভূমি তো দেশের বাইরে নয়। তিনি আজীবন খুঁজেছেন সেই ‘দেশ’-এর সংজ্ঞা। জীবনের বহু অভিজ্ঞতার সঞ্চয় তাঁকে রাঢ়ের রুক্ষ-শুষ্ক মাটিতেও দেশকে চিনতে শিখিয়েছিল। 

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৮ সালে বীরভূমের লাভপুরে। গ্রামে আজও রয়েছে ৫১ সতীপীঠের একটি পীঠ। পাশ দিয়ে বয়ে যায় কোপাই নদী। তাঁর পরিবার ছিল গ্রামের জমিদার। ফলে ধর্ম-সংস্কার ও ক্ষমতার সংমিশ্রণ দেখেছিলেন ছোটোবেলা থেকেই। পিতা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনযাপন একসময় উচ্ছৃঙ্খল হলেও পরের দিকে চলে আসে একটা আধ্যাত্মিক গাম্ভীর্য। যা কিছুটা ভয়ের সঙ্গে হলেও তীব্র আকর্ষণে টানত তারাশঙ্করকে। পিতার সঙ্গ তিনি বেশিদিন পাননি। বরং জীবন চিনতে শিখিয়েছিলেন মা আর পিসিমা। 

তাঁর নিজের ভাষায় মা প্রভাবতী দেবী ছিলেন মূল ‘প্রেরণাদাত্রী’। জমিদার বংশ তখন ক্ষয়িষ্ণু। বনেদি আভিজাত্যের বাহুল্য আর শরিকী মামলার খরচ সামলে কোনোরকমে টিকে থাকা। পিতা যদি প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক হন, মা তাহলে নতুন কালের ‘জ্যোর্তিময়ী’ শিখা। পাটনার প্রবাসী বাঙালি ঘরের মহিলা, পড়াশোনাতেও ছিল প্রবল আগ্রহ। ছোটো তারাশঙ্করকে শোনাতেন পুরাণ, মহাভারত, রামায়ণ। তাঁর হাত ধরেই একদিকে এসেছে দেশের প্রতি ভালোবাসা, অন্যদিকে গল্প গলার প্রেরণা। তারাশঙ্কর লিখছেন, “আমার জীবনে মা-ই আমার সত্যসত্যই ধরিত্রী, তাঁর মনোভূমিতেই আমার জীবনের মূল নিহিত আছে, শুধু সেখান থেকে রসই গ্রহণ করেনি, তাঁকে আঁকড়েই দাঁড়িয়ে আছে।”

কৈশোর-যৌবনের অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন পিসিমা। কম বয়সেই বিধবা হয়েছেন, হারিয়েছেন সন্তান আর বোনেদেরও। ফলে সবসময় রুক্ষমূর্তি ধারণ করে থাকতেন। মৃত পিতার স্থান নিলেন তিনি। কড়া শাসন, কুসংস্কার আর সেই পুরনো জমিদারি মেজাজ দিয়ে গড়ে তুলতে চাইলেন তারাশঙ্করকে। অথচ অন্তরে বাসা বেঁধেছিল শিশুর মতো সারল্য। বলাই বাহুল্য যে, ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাসে পিসিমা চরিত্রের রূপ তৈরি হয়েছিল বাস্তব জীবন থেকেই। তাঁর খুব ইচ্ছা ছিল তারাশঙ্কর উকিল হোক, লাভপুরের কাছারিতে বসে তামাক খেতে খেতে ফিরিয়ে আনুক অতীতের গরিমা। কিন্তু জীবন বয়ে চলল অন্যখাতে। কিছুটা মায়ের আশীর্বাদেই। 

আরও পড়ুন
মানিক বন্দ্যোর গল্প থেকে মানিকবাবুর না-হওয়া ছবি

বিশ শতকের শুরুতেই বাংলাব্যাপী স্বদেশি আন্দোলনের আঁচ এসে পড়ল লাভপুরেও। প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে না পড়লেও, প্রভাবিত হয়েছিলেন সেসব কর্মকাণ্ডে। পড়তে শুরু করলেন স্বামী বিবেকানন্দের গ্রন্থ। শুরু হল দেশ চেনার প্রক্রিয়া। অবশ্য পরিপূর্ণ সুযোগ মিলল কলকাতায় পড়তে আসার পর। মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন। কিন্তু কোন পথ নেবেন তিনি? স্বদেশি আন্দোলনের আগুন নিভন্ত, সশস্ত্র সংগ্রামেও মন পুরোপুরি সায় দিতে পারছে না। ১৯২০-র সময়ে পরিচিত হলেন এক নতুন নামের সঙ্গে— মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। নতুন উদ্যমে শুরু করলেন দেশের কাজ। গ্রেপ্তার হলেন বেশ কয়েকবার।

আরও পড়ুন
প্রবল অর্থাভাব, তবু ছাড়বেন না বাংলা; বম্বের ডাক ফেরালেন ‘চিত্রনাট্যকার’ তারাশঙ্কর

জেলেই আলাপ হয় সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে। কথাবার্তায় ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ইতিমধ্যেই ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’-এ প্রকাশিত হতে শুরু করেছে তাঁর লেখা। একই সঙ্গে চলছে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেশসেবা। যদিও কিছুটা উদ্দেশ্যহীন, তবুও জমিদারি চালানোর চেয়ে ঢের ভালো। এই সময়ে কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ দলাদলিতে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে একপ্রকার দূরত্ব তৈরি হয়। তারাশঙ্কর নিজে গেলেন তাঁর কাছে। বুঝিয়ে বললেন ভিতরের সমস্যাগুলি। লনে পায়চারি করতে করতে সুভাষচন্দ্র পুরোটা শুনলেন, ফিরে এল হারানো বিশ্বাস। তার কয়েকবছর পরেই প্রকাশিত হল তারাশঙ্করের প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’। যা উৎসর্গ করা হয়েছিল সুভাষচন্দ্রকে।

সমস্ত বৈষয়িক কাজ থেকে মুক্তি নিয়ে বোলপুরে শুরু করলেন একটি ছাপাখানা। মূল উদ্দেশ্য দেশপ্রেম-মূলক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করবেন। এদিকে ঘরে অভাব, পত্রিকা চালানোর খরচও কম নয়। শেষে হাত পাতলেন স্ত্রী-র কাছে। তাঁর অলংকার বিক্রির টাকায় শুরু হল প্রেসের কাজ। যদিও বেশিদিন চলেনি পত্রিকাটি। একটি মিথ্যে মামলায় ফেঁসে যাওয়ায় জরিমানা হল বড়রকমের। তিনি কি মাথা নত করবেন ইংরেজ জুলুমের কাছে? ফের শরণাপন্ন হলেন সুভাষচন্দ্রের। স্পষ্টভাষায় এল উত্তর, “না। বন্ধ করে দিন। বণ্ডও দেবেন না। জামিনও দেবেন না।” এটাই শুনতে চেয়েছিলেন তারাশঙ্কর। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু শেষপর্যন্ত বজায় ছিল স্বাজাত্যপ্রীতি।

চারের দশকে সখ্যতা গড়ে ওঠে ‘প্রগতি লেখক শিল্পী সংঘ’-এর সঙ্গে। আদতে বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত হলেও প্রথমদিকে মঞ্চটি ছিল প্রগতিশীল চিন্তাধারার সবার জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু রাজনৈতিক সংকীর্ণতা এসে পড়ে এখানেও। ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ সম্পর্কে বলা হল এটা সাহিত্যই নয়, এটা ‘রোম্যান্টিক অ্যাডভেঞ্চারিজম’। চলতে থাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ের ষড়যন্ত্র। বীতশ্রদ্ধ হয়ে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার সম্পাদক পি. সি. যোশীকে চিঠি লিখে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করেন তারাশঙ্কর। অথচ, তিনিই পরের দিকে ‘অমৃত’ পত্রিকায় লেনিন সম্পর্কে লিখেছেন, “আমাদের দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে যত মত-পার্থক্যই থাক, এই আশ্চর্য মানববন্ধুটি আজও আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং আজও তিনি আমার পথপ্রদর্শক।”

দেশ মানে তো কয়েকটি মতাদর্শ বা সংগঠনের ঠিকানা নয়। আরও মহৎ তার পরিচয়। কোনো বিশেষ রঙের চশমা এঁটে তিনি মানুষকে দেখেননি। বহু দরজায় গেছেন দেশের প্রকৃত সত্তার সন্ধানে, পরস্পরবিরোধী হলেও গ্রহণ করেছেন সবকটি মতকে। আর শেষ পর্যন্ত ফিরে এসেছেন তাঁর গ্রাম লাভপুরে। আদিবাসী সম্প্রদায় কিংবা অচ্ছুৎ মানুষদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে চিনেছেন নিজের দেশকে। তারাই যে দেশের প্রাচীনতম প্রতিনিধি। তারাই হয়ে উঠেছে তারাশঙ্করের সাহিত্যের মূল চরিত্র। রাঢ়ের লোকজীবনে প্রবেশ করেছে আধুনিক সভ্যতার দ্বন্দ্ব, মিশে গেছে সারা ভারতের চেতনা।

Powered by Froala Editor

More From Author See More