অনুরূপা দেবী—এক ফেলে আসা ‘সাহিত্যসম্রাজ্ঞী’-র খোঁজে

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের কলকাতা। শিক্ষা, সমাজ, ধর্ম সমস্ত ক্ষেত্রেই চলছে একটা তীব্র দ্বন্দ্ব। ব্রিটিশরা এদেশে থিতু হয়েছে বহুদিন, ছড়িয়ে পড়েছে ইংরেজি শিক্ষা। কিন্তু ঠিক হয়নি তার গ্রহণ-বর্জনের মাপকাঠি। সাহিত্যে চলছে হিন্দু পরম্পরার সন্ধান। বয়ে চলেছে ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিক স্রোত। আবার, তুলনায় রক্ষণশীল সমাজ তখনও আঁকড়ে ধরে রেখেছে অতীতের রীতিনীতি। বিশেষত নারীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার বিষয়টি ক্রমশ প্রচলিত হতে থাকলেও, আশঙ্কার ছবিটি প্রকাশ্যে এসে পড়ে মাঝেমধ্যেই। প্রাচীন ঐতিহ্য নষ্ট হবে, দেশ রসাতলে যাবে, আরও কত কিছু যে শোনা যায়!

দ্বিধা তখন কলকাতা শহরের অপরিহার্য অঙ্গ। ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলির মধ্যেও প্রায়ই মতপার্থক্য লেগে থাকে। সাহিত্যিক ভূদেব মুখোপাধ্যায় (Bhudeb Mukhopadhyay) একবার পুত্রবধূ ধরাসুন্দরী দেবীর পিয়ানো ও ইংরেজি শিক্ষার জন্য নিয়ে এলেন মিসেস কলিন্সকে। যিনি আবার মধুসূদন দত্তের কন্যা শর্মিষ্ঠা-এর আত্মীয়া। ধরাসুন্দরীর বাবা নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রক্ষণশীল মনোভাব ভালোভাবে দেখেননি বিষয়টি। যদিও ধোপে টেকেনি তাঁর আপত্তি। 

ধরাসুন্দরী দেবী ও মুকুন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের কন্যা অনুরূপা দেবী (Anurupa Debi)। জন্ম ১৮৮২ সালে। পরবর্তীকালে বাংলা গল্প-উপন্যাসে তিনি রেখেছিলেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। সজনীকান্ত দাস তাঁকে বলতেন ‘সাহিত্যসম্রাজ্ঞী’। উনিশ শতকের শেষ আর বিশ শতকের শুরুর এক সংক্রান্তিকালে তাঁর বড়ো হয়ে ওঠা। ফলে পিতামহের শিক্ষা পেলেও, নগেন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারেননি তিনি। অনুরূপা দেবীর সাহিত্য নারী স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার হলেও সময়ের দ্বন্দ্বের কারণেই তার তীব্রতায় এসে পড়ে প্রাচীন মূল্যবোধের ছোঁয়া।

খুব কম বয়সেই গুরুতর রোগে আক্রান্ত হওয়ায় সুযোগ পাননি স্কুল-কলেজে পড়ার। দিদি সুরূপা দেবী রোগশয্যায় শোনাতেন রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের গল্প। ফলে তখন ‘নিরক্ষর’ হলেও শিক্ষার চর্চার শুরু হয়ে গেছে ভিতরে। সাত-আট বছরে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের কাছে শিক্ষা শুরু। সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি আর কিছু অঙ্ক। দোয়াত-কালি নিয়ে বসে যেতে হত রোজ সকালে। চুঁচুড়ার বাড়িতে সেই সময়ে চাঁদের হাট বসত মাঝেমধ্যেই। প্রকাশিত হত ‘এডুকেশন গেজেট’। বঙ্কিমচন্দ্র এসেছিলেন দুয়েকবার। অনুরূপা দেবী লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তেন ‘সীতারাম’ আর ‘দেবী চৌধুরানী’। গঙ্গার পাড়ের বাড়িতে হাওয়া বদলের জন্য প্রতিবেশী হয়ে আসতেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

আরও পড়ুন
স্বল্পমূল্যে একের পর এক চিরায়ত সাহিত্য; বইপাড়ার ‘ডার্ক হর্স’ রিফ্লেক্ট পাবলিকেশনের গল্প

মাত্র ১০ বছর বয়সেই অনুরূপা দেবীর বিয়ে হয়ে যায় উত্তরপাড়ার শিখরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কিন্তু পড়াশোনায় ছেদ পড়েনি। স্বামীর হাত ধরেই যথার্থ ইংরেজ শিক্ষা লাভ করেন তিনি। চাকরিসূত্রে তাঁর সঙ্গে মজঃফরপুর চলে যাওয়া অনুরূপা দেবীর জীবনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে। ওখানেই তাঁর বন্ধুত্ব হয় রবীন্দ্রনাথের কন্যা মাধুরীলতার সঙ্গে। দুজনে মিলে ‘চাপ-ম্যান গার্লস স্কুল’ নামে মেয়েদের একটি স্কুল তৈরি করেন। নিজেরাই চালিয়েছিলেন বেশ কয়েকদিন। একে-অপরকে উৎসাহ দিতেন সাহিত্যরচনার জন্য। ১৯১৮ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে মাধুরীলতার অকালমৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ অনুরূপা দেবীকে বলেছিলেন,

আরও পড়ুন
শতবর্ষ পূর্ণ করলেন ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’-র প্রণেতা অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

“তোমার দেখাদেখি ইদানিং গল্প লিখতে আরম্ভ করেছিল, বেঁচে থাকলে হয়ত তোমার মতো লিখতে পারত।”

১৯০৪ সালে রাণী দেবী ছদ্মনামে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম ছোটোগল্প ‘মুক্তি’। গল্পটির জন্য পান কুন্তলীন পুরস্কার। প্রথম উপন্যাস ‘টিলাকুঠী’-ও প্রকাশিত হয় এ বছর। ক্রমে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে সরলা দেবী চৌধুরানীর সঙ্গে। তাঁর সূত্রেই ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘পোষ্যপুত্র’ উপন্যাসটি। তারপরই বাংলা উপন্যাসের জগতে জনপ্রিয়তা পান অনুরূপা দেবী। ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘মহানিশা’, ‘মা’-সহ লিখেছেন ৩৩টি উপন্যাস। সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা ছোটোগল্পকেও। তাঁর অনেক গল্প-উপন্যাস থেকে তৈরি হয়েছে কালজয়ী নাটক ও সিনেমা। ১৯৪৪-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘লীলা লেকচারার’ বক্তৃতামালায় ‘সমাজ ও সাহিত্যে নারী’ বিষয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘ বক্তব্য। একদিকে মহিলা সাহিত্যিকগণ, অন্যদিকে সাহিত্যের মহিলা চরিত্রদের তুলনামূলক আলোচনাটিতে তাঁর ভিন্নধর্মী দৃষ্টিশক্তির পরিচয় মেলে।

উনিশ শতকের যে দ্বিধার কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল, একবার ফিরে যাওয়া যাক সেখানে। বিদ্যাসাগর সারা বাংলা ঘুরে বেড়িয়েছিলেন মহিলাদের স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য। কলকাতাতেও এগিয়ে আসেন অনেকেই। যদিও প্রদীপের তলাটা আসলে অন্ধকার। নারীশিক্ষা বা স্বাধীনতার জ্ঞানবাক্যগুলি আটকে থেকেছে সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে। নারী মানে তো পুরুষের ‘সম্পত্তি’, সংসার নামক যন্ত্রটি নিয়ে পুতুলখেলাই তাঁর একমাত্র অধিকার। অনুরূপা দেবীর অধিকাংশ গল্প-উপন্যাসই এই শৃঙ্খল ভাঙার চেষ্টা করেছে। এসেছে সমানাধিকারের প্রশ্ন। উদাহরণ দেওয়া যাক ‘উড়ো চিঠি’ গল্পটি থেকে,

“যেমন পুরুষরা অসতী বর্জন করে চলে, মেয়েদের বেলাও সেরকম বিধান থাকা কি অসঙ্গত?”

সমাজকে আক্রমণ করেছেন তিনি বহুভাবে। নিজের ব্যক্তিত্বের আলোয় নারী চরিত্রদের করতে চেয়েছেন আত্মবিশ্বাসী। ত্যাগে-কঠোরতায়, সহিষ্ণুতা-প্রতিবাদে ভারতীয় নারীর ‘চিরন্তন’ রূপ খুঁজতে চেয়েছেন তিনি। যার কাঠামো শরৎচন্দ্রের নারীদের থেকে একেবারেই আলাদা। 

শুধু সাহিত্যে নয়, জীবনেও সক্রিয় ছিলেন নারী শিক্ষা বিস্তারে। বারাণসির হিন্দু মহিলাশ্রম, আর্য বিদ্যালয়, মাতৃমঠ প্রভৃতির অধ্যক্ষার দায়িত্বপালন করেছেন দীর্ঘদিন। জড়িত ছিলেন কলকাতার কয়েকটি নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও। আবার বিরোধিতা করেছিলেন হিন্দু কোড বিলের। রীতিমতো পথে নেমে, সভা করে। বিয়ে নামক ‘সংস্কার’-টি নিয়ে ছিলেন অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। যে নারীর রূপ তিনি এঁকেছেন, তাতে শেষ পর্যন্ত ‘সর্বংসহা’ চরিত্রটিই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। যা হয়তো বঙ্কিমচন্দ্রের ঘরনার সঙ্গে মিলে যায় অনেকটা। শরৎচন্দ্রের বেদনা ও মহিমা যেন কিছুতেই যথাযথভাবে মেশে না অনুরূপা দেবীর সাহিত্যে। অবশ্য ব্যক্তিজীবনে কখনও বিরোধিতা করেননি ভিন্ন মতাদর্শের মানুষদের। 

শেষ জীবনে একাধিক আত্মীয়ের মৃত্যুশোক ব্যথিত করেছিল তাঁকে। ১৯৫৮-তে মৃত্যু ঘটে তাঁর। বাংলা সাহিত্যে মহিলা ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অনুরূপা দেবী হয়তো আজকের দিনে বহুচর্চিত নাম নয়। কিন্তু তৎকালীন সময়ের জনপ্রিয়তায় তিনি ছিলেন ‘সাহিত্যসম্রাজ্ঞী’। এবং একই সঙ্গে যুগসন্ধিক্ষণের নারীকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থ প্রতিনিধি।

Powered by Froala Editor