পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি আন্দোলনের প্রধান মুখ যে-ব্যক্তি

১৯০৮ সাল। পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষে জন্মানো মানুষটা তখন আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। পুরুলিয়ায় আইন অনুশীলন শুরু করেন। কিন্তু এই মানুষটিই দেশে অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে ওকালতি ছেড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। তিনি অতুলচন্দ্র ঘোষ (Atul Chandra Ghosh)। ১৮৮১ সালের ২ মার্চ তাঁর জন্ম। কেবল মুক্তিযোদ্ধাই নন, লোকসেবক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা এবং পুরুলিয়া জেলার বঙ্গভুক্তি আন্দোলনের প্রধান মুখও তিনি।

মানভূমের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বে ছিলেন অতুলচন্দ্র ঘোষের শ্বশুর নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত। অসহযোগ আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হন নিবারণ। মুক্তির পর, তিনি অতুলচন্দ্রের সঙ্গে 'শিল্পশ্রম' (Shilpashram) প্রতিষ্ঠা করেন, যা মানভূম জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৬ সালে গ্রাম চৌকিদারি আইনের প্রস্তাব করে। লক্ষ্য, গ্রামবাসীদের চৌকিদারি পরিষেবা দেওয়ার জন্য তাদের কাছ থেকে কর আদায়। চৌকিদারেরা একাধারে ব্রিটিশ সরকারের গুপ্তচর, অন্যদিকে স্থানীয় জমিদারদের চাকর। সেই কারণে গ্রামবাসীদের বিশ্বাস জিততে পারেনি তারা। বরং তাদের অপছন্দই করতেন গ্রামের মানুষ। লবণ আইন ভঙ্গ করার জন্য ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে শুরু হওয়া আইন অমান্য আন্দোলন পূর্ব ভারতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ওই বছর ৮ এপ্রিল, জাতীয় আইন অমান্য আন্দোলনের অংশ হিসাবে রাঁচিতে একটি বিশাল সভা আয়োজিত হয়। সেখানে মানভূম জেলা সত্যাগ্রহ কমিটির সেক্রেটারি অতুলচন্দ্র ঘোষ জনগণকে চৌকিদারি ট্যাক্স না দেওয়ার আহ্বান জানান। এই 'নো চৌকিদারি ট্যাক্স' অভিযান শেষ পর্যন্ত চৌকিদারদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করে।

আইন অমান্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানভূমের (Manbhum) বহু নেতা গ্রেফতার হয়েছিলেন। মুক্তির পর তাঁরাই লোকসেবক সংঘ (এলএসএস) প্রতিষ্ঠা করেন। এলাকার তথাকথিত অস্পৃশ্য মানুষ ও আদিবাসীদের জীবনমান উন্নীত করাই এই সামাজিক সংস্কার প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য। অতুলচন্দ্র ঘোষ এলএসএসের (LSS) নেতা হওয়ার পাশাপাশি জেলা কংগ্রেস কমিটির অন্যতম নেতা ছিলেন। ১৯৪২-এর ৯ আগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়। এসময় মানভূম জেলা কংগ্রেস কমিটির অংশ এলএসএস কর্মীদের গ্রেফতার করে ব্রিটিশ সরকার তাদের অফিস বন্ধ করে দেয়। জেলার তরফে সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সভায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন অতুলচন্দ্র ঘোষ। বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী-কন্যাসহ ব্রিটিশ পুলিশের জালে ধরা পড়েন তিনি।

আরও পড়ুন
স্বাধীনতার পর, সরকারের দেওয়া পেনশন নিতেও অস্বীকার করেন বীণা

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভের পর মানভূম জেলা চলে যায় বিহারে। কিন্তু এই মানভূমের বিরাট একটা অংশে বাঙালিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কংগ্রেস জেলা কমিটির সভাপতি হিসাবে অতুলচন্দ্র ঘোষ মানভূমকে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি প্রস্তাব তুলে ধরেন। তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হলে কংগ্রেস পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৪৮ সালে অতুলচন্দ্র ঘোষ, বিভূতি দাশগুপ্ত এবং অন্যান্যরা মিলে এলএসএসকে সামাজিক সংস্কার সংগঠন থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করেন। এই কর্মকাণ্ডের ফলেই পুরুলিয়াকে বঙ্গভুক্তির গণআন্দোলন শুরু।

আরও পড়ুন
দেশের জন্য লড়েও ছাড়তে হয়েছিল ভিটে, দিনাজপুরের ‘অবজ্ঞাত’ স্বাধীনতা সংগ্রামীর গল্প

এলএসএস সভাপতি অতুলচন্দ্র জেলাজুড়ে 'ভাষা সত্যাগ্রহ' আয়োজন করেন। পরে 'বঙ্গ সত্যাগ্রহ অভিযান' নামে একটি লং মার্চও আয়োজিত হয় তাঁর নেতৃত্বে। 'মুক্তি' নামে একটি পত্রিকা শুরু করেছিলেন নিবারণচন্দ্র। পত্রিকাটি সম্পাদনা করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন অতুলচন্দ্র। বলা চলে, 'বঙ্গ সত্যাগ্রহ'-এর কণ্ঠস্বর ছিল 'মুক্তি'। এলএসএস-এর প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সাফল্য লাভ করে। ১৯৫৩ সালে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন তাদের দাবি মেনে নেয়। ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর, পূর্বতন বিহার রাজ্যের মানভূম জেলার সদর মহকুমাটি পুরুলিয়া (Purulia) জেলা নামে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই থেকে এই জেলা পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গ। আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ও অবদানের জন্য 'মানভূম কেশরী' উপাধি পেয়েছিলেন অতুলচন্দ্র ঘোষ। ১৯৬৯ সালের ১৫ অক্টোবর অতুলচন্দ্রের মৃত্যুর পর বাংলা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র 'মুক্তি'র সম্পাদনার দায়িত্ব নেন তাঁর স্ত্রী স্বাধীনতা সংগ্রামী লাবণ্যপ্রভা ঘোষ।

অথচ, তাঁর নাম কতটা চর্চিত আজ? ইতিহাসের পাতা থেকে প্রায় মুছে গেছে তাঁর অস্তিত্ব। বাঙালির জন্য, বাংলা ভাষার জন্য তিনি তুলে ধরেছিলেন ‘মুক্তি’র আহ্বান। বাঙালিও কি স্মৃতি থেকে ‘মুক্ত’ করে দিয়েছে অতুলচন্দ্র ঘোষের নাম? 

Powered by Froala Editor