অদ্ভুত এক সারল্য, পাহাড়ের গন্ধ মিশে থাকে তাঁর লেখায়। সাধারণ মানুষের জীবনের গল্পেই মাখানো থাকে অদ্ভুত এক মায়া। যা সিক্স থেকে সিক্সটি সকলকেই আমোদিত করতে পারে অনায়াসেই। সেই মাদকতার নামই হল রাস্কিন বন্ড। ভারতীয় ইংরাজি সাহিত্যের অন্যতম এক নক্ষত্র তিনি। জন্মসূত্রে ব্রিটিশ হলেও তাঁর বেড়ে ওঠা সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে। নিজের জন্মভূমির মত করেই তিনি দেখেছেন এই দেশকে। আর পাঁচটা ভারতীয় নাগরিকদের থেকে তাঁর এই দেখাটা যে অনন্য, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তাঁর লেখক হওয়ার ইচ্ছে শুনে হেসেছিলেন স্বয়ং তাঁর মা।
সম্প্রতি নিজেই এই কথা জানালেন রাস্কিন বন্ড। নিজের জীবনীর ওপর স্মৃতিচারণা করেই কয়েকটি বইয়ের সিরিজ লিখছিলেন তিনি। এই সিরিজের চতুর্থ বই ‘আ সং অফ ইন্ডিয়া’-র প্রকাশের সূত্রেই সম্প্রতি এই তথ্য প্রকাশ করেন তিনি। .
রাস্কিন বন্ড জানান, স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই তিনি ভাল বেসে ফেলেছিলেন ইংরাজি সাহিত্যকে। তখন বোর্ড পরীক্ষা হয়ে গেছে, কিন্তু রেজাল্ট বের হয়নি। বাড়িতেই রয়েছেন তিনি। ইংরাজি, ইতিহাস আর ভূগোল নিয়ে বেশ নিশ্চিন্তেই ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর চিন্তার কারণ ছিল অঙ্ক আর ভৌতবিজ্ঞান। তাই পরবর্তীতে কী করবেন, ঠিক নেই তারও। এমনই একদিন তাঁর মাকে বলে বসেছিলেন নিজের মনে মনে লালন করা ইচ্ছেটার কথা। লেখক হওয়ার স্বপ্নের কথা। যা শুনেই হেসে ফেলেছিলেন তাঁর মা। মজার ছলেই বলেছিলেন, ‘হাতের লেখা সুন্দর হওয়ায় যে কোনো আইনজীবীর কাছে ক্লার্কের চাকরি মিলবে তাঁর’।
তবে হতাশার শেষ এখানেই নয়। তাঁর এই লেখক হওয়ার ইচ্ছের কথা খুব তাড়াতাড়িই ছড়িয়ে গেল চারিদিকে। আর আশ্চর্যজনকভাবে কেউই ঠিক মেনে নিতে পারলেন না এই লেখক হওয়ার ইচ্ছেকে। এর পর সকলের ইচ্ছেগুলোই একটু একটু করে যেন চেপে বসল তাঁর ওপরে। তাঁর বাবা তাঁকে উচ্চশিক্ষার জন্য কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা বললেন। মা জানালেন সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য। প্রধান শিক্ষক বলেই বসলেন, ভবিষ্যতে শিক্ষক হওয়ার কথা।
কিন্তু রাস্কিন বন্ডের কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল না কোনো। ‘শিক্ষক তো একেবারেই নয়। যে শাসন, রুটিন, হোমওয়ার্ক, পিটি নিজেই পছন্দ করতাম না। তা অন্যদের ওপরে চাপিয়ে দিই কীভাবে? অন্যদিকে যদি সেনাবাহিনীতে যোগ দিই তবে সেখানে আরও বড় সমস্যা। এইসব নিয়ম-নিষেধের বলি হতে হবে নিজেকেই’, বলছিলেন রাস্কিন বন্ড।
তবে এতদিনের পুষে রাখা ইচ্ছেকে কি ছেড়ে এগিয়ে যাওয়া যায়? তিনি নিজেই খুঁজে নিলেন সেই রাস্তা। তবে এবার আর জানালেন না কাউকেই। লাইব্রেরি থেকে নিয়ে এলেন এক গুচ্ছ বই। জেমস হিলটন, অগাথা ক্রিস্টি, ডর্নফোর্ড, সমারসেট মওঘাম, ওডহাউস বাদ দিলেন না কিছুই। নতুন ও পুরনো ধারার ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়লেন বিস্তারিত। তাতে ধারণাও হল তাঁর অনেকটাই। এই প্রসঙ্গেই তিনি জানান, মাত্র ২ টাকার বদলেই বই ভাড়া পাওয়া যেত লাইব্রেরি থেকে। যা তাঁর কাছে বর হয়ে আসে।
আরও পড়ুন
‘আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী সাহিত্যের পণ্ডিতরা’, কিশোর কবির আত্মহত্যার পিছনে কোন রহস্য?
বিস্তারিত ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করার পরে শুরু করলেন লেখালিখি। সেই সময়ে বাবার থেকে দু-এক টাকা হাত খরচ হিসাবে পেতেন রাস্কিন বন্ড। এবার স্বনির্ভর হওয়ার তাগিদেই সেই টাকায় নিজের লেখা-লিখি পাঠানো শুরু করলেন দেশের বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। প্রথমে বেশ কয়েকবার নিরাশ হলেও শেষমেশ মাদ্রাজের এক ছোট পত্রিকা ‘মাই ম্যাগাজিন অফ ইন্ডিয়া’-তে প্রকাশ পায় তাঁর একটি গল্প। কিছুদিন বাদে রাস্কিন বন্ডকে আশ্চর্য করেই পোস্টাল অ্যাড্রেসে আসে একটি পাঁচ টাকার মানি অর্ডার। গল্পটির সাম্মানিক হিসাবে। সেই শুরু। তারপর থেকে মাঝেমাঝেই আসতে থাকল পাঁচ টাকার মানি অর্ডার। তাতে নতুন উদ্যমেই তিনি শুরু করলেন লেখালিখি।
মাত্র ১৭ বছর বয়সেই রাস্কিন বন্ড হাত লাগালেন তাঁর প্রথম উপন্যাস। ‘দ্য রুম অফ দ্য রুফ’। অবশ্য তাঁর এক বছরের মধ্যেই ভারত ছেড়ে তাঁর বিদেশে পাড়ি দেওয়া। ইংল্যান্ড। জন্মসূত্রে যে দেশের মানুষ তিনি। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হল সেই লেখা। ভারতে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছেলে ‘রাস্টি’ ছিল সেই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। ব্যক্তিগত জীবনীকেই উপন্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই বইয়ের দৌলতে এসেছিল জন লেভেলিন লাইজ পুরস্কার।
পুরস্কার সেই সাম্মানিক অর্থ সঞ্চয় করেই আবার ভারতে ফিরেছিলেন তিনি। এই দেশেই ছিল তাঁর রসদ, বেড়ে ওঠার শিকড়। ভারতে ফেরার পর প্রায় ৪০টির বেশি বই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর। ৫০০-র বেশি ছোট গল্প। সাহিত্য অকাদেমী পুরষ্কার, পদ্মশ্রীও জুড়েছে তাঁর নামের পাশে। অথচ, তাঁর এই লেখক হওয়ার ইচ্ছে, স্বপ্ন, চেষ্টা ছোটোবেলায় আমল দেননি তাঁর অভিভাবকরাই। সত্যিই অবাক করার মতপই। জীবনীর চতুর্থ বই প্রকাশের মধ্যে দিয়ে সেই স্মৃতিচারণই করলেন রাস্কিন বন্ড। আরও একবার জানালেন, আক্ষেপ না রেখেই স্বপ্নপূরণের তাগিদে উদ্দেশ্যহীন ছুটে চলার মধ্যেও এক অন্যরকম আনন্দ আছে। আছে এক অন্যরকম বেঁচে থাকা...
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-বিভূতিভূষণ থেকে সন্দীপন, বাংলা সাহিত্য মহামারীর সাক্ষী থেকেছে বরাবরই
Powered by Froala Editor