দার্জিলিংয়ের সীমানায় ছোট্ট এক হিল স্টেশন। শান্ত পরিবেশ, পাহাড়ি গানের মাঝেই বসবাস করছেন মানুষরা। সকলেই শান্তি খুঁজছেন, প্রকৃতির মাঝখানেই মেলে ধরতে চাইছেন নিজেদের। সেই পাহাড়িয়া পরিমণ্ডলেই হাজির হয়েছেন এক তরুণ। কতই বা বয়স তাঁর! কিন্তু এই বয়সেই পেয়েছেন গুরুদায়িত্ব। দার্জিলিংয়ে এই মানুষগুলোর শিক্ষকের ভূমিকায় থাকবেন তিনি। মাত্র পাঁচ মাস; তার মধ্যেই সেই শান্ত হাওয়া তরুণের মধ্যে ঢুকে গেল। দিলেন যত, নিয়ে ফিরলেন তার থেকে অনেক বেশি।
তারপর কেটে গেছে বহু বছর। সেদিনের সেই তরুণ আজ জীবনের ৪৪টা বসন্ত পেরিয়ে এসেছেন। দার্জিলিং ছেড়ে তাঁর যাত্রাপথ অনেকটা এগিয়ে গেছে। প্রতিটা বাঁকে নতুন দৃশ্য, নতুন চরিত্র। তাঁর গণ্ডি কেবল জন্মস্থান লন্ডন বা দার্জিলিংয়েই আটকে নেই। ‘শার্লক হোমস’-কে কি এত সহজে ভোলা যায়? অবশ্য আয়নায় অজস্র প্রতিবিম্ব; কখনও দুর্ধর্ষ শার্লক, কখনও সুপারহিরো ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ’, কখনও মঞ্চে নামছেন হ্যামলেট হয়ে। বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ সেই অদ্ভুত প্রতিভার নাম। আজ এত সফল হওয়ার পরও তিনি ভোলেননি সদ্য-যৌবনের দার্জিলিংকে। যখনই সুযোগ হয়েছে, ফিরে গেছেন সেই পাহাড়ের কাছে। শারীরিকভাবে না হোক, মনটাকে তো স্মৃতির পাতায় ঠাই দেওয়াই যায়…
বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে দার্জিলিংয়ের সেই দিনগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন বেনেডিক্ট। তখন তিনি ১৯ বছরের সদ্য স্কুল পেরোনো এক তরুণ। যৌবনের দরজায় সবেমাত্র পা রেখেছেন। এমন সময় ঠিক হল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে কয়েক মাস শিক্ষকতা করে নেওয়া যাক। একটা অভিজ্ঞতা হবে জীবনের। তরুণ বেনেডিক্ট চলে এলেন দার্জিলিংয়ে। সেখানেই একটি তিব্বতি মনাস্ট্রিতে শুরু হল জীবনের অনন্য এক অধ্যায়। বৌদ্ধমঠের ওই ভিক্ষু, ওই শান্তিপ্রিয় মানুষদেরকে ইংরেজি শেখাতে হবে…
হাতে সময় মাত্র পাঁচ মাস। না, এই কাজের জন্য টাকা উপার্জন করেননি বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ। বদলে পেয়েছিলেন জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। তাঁর সঙ্গে মোট পাঁচজন দার্জিলিংয়ের এই মঠে শিক্ষকতা করতে এসেছিলেন। সেখানে মোলায়েম বিছানা নেই, লন্ডনের মতো স্বাচ্ছন্দ্য নেই। খালি মেঝেতে শুতে হত তাঁদের; কখনও কখনও সেখান দিয়ে হেঁটে যেত মাকড়সা। সেইসঙ্গে ছিল শীত। তবে এসবের বাইরে ছিল এক অপার শান্তি। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সেই সুন্দর, নিরালা পরিবেশের সঙ্গে একেবারে মিশে যেতেন। বেনেডিক্ট অবাক হয়ে দেখতেন তাঁদের। তিনি নিজে এসেছেন ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে, কিন্তু দিনের শেষে সেই পরিবেশ, সেই ভিক্ষুরাই তাঁকে জীবন সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে যেত।
আরও পড়ুন
প্রয়াত 'ব্ল্যাক প্যান্থার' বোসম্যান,ক্যানসার কেড়ে নিল ৪৩ বছরের অভিনেতাকে
দার্জিলিংয়ের ওই পাঁচটি মাস, বেনেডিক্টের মনে বুদ্ধের আদর্শ, জীবনদর্শন সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে দেয়। তিব্বতি বৌদ্ধদের সাধারণ পবিত্র জীবন তাঁর মনে ছাপ ফেলে যায়। আর সঙ্গে দার্জিলিং তো আছেই। পরবর্তীকালে যখনই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, জীবনের ওই পাঁচটি মাসকে ‘সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন। সেখান থেকে যা শিক্ষা পান, নিজের জীবনে প্রয়োগ করেন। ভেতরে ভেতরে সেই বুদ্ধের কাছেই নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন বেনেডিক্ট ‘শার্লক’ কাম্বারব্যাচ। পরবর্তীকালে ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ’-এর চরিত্র করার সময় আবারও ফিরে গিয়েছিলেন সেই পাহাড়ে। আরও একবার ঝালিয়ে নেওয়া সেই ১৯ বছরের ছেলেটাকে। এবার আর শিক্ষক নয়, অভিনেতা বা সেলেব্রিটি হিসেবে নয়; একজন মানুষ হিসেবে ফিরে এসেছিলেন। দার্জিলিং, বুদ্ধ আর জীবন— সবকিছু মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বেনেডিক্ট। হাজার হাজার চরিত্রের মাঝে একটা অন্যরকম ‘আমি’ হয়ে…
তথ্যসূত্র-
১) ‘Benedict Cumberbatch forever grateful for Life lessons learned at Darjeeling Monastery’, Anne Wiseman, Buddhistdoor Global
২) ‘The Darjeeling Connection: Yes Benedict Cumberbatch was here during his gap year’, The Darjeeling Chronicle
আরও পড়ুন
অভিনেতা! পদার্থবিজ্ঞানী নন? সুশান্তের পেশা শুনে অবাক হয়েছিলেন কেমব্রিজের গবেষক
Powered by Froala Editor