ভারতীয় ক্রিকেটে তখন সি কে নাইডু ট্রফির গুরুত্বই আলাদা। এখানে ভাল খেললে রঞ্জি ট্রফি খেলার সুযোগ আসে। তাঁর স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হবেন, চান্স পেয়েছিলেন অনূর্ধ্ব-২৩ সি কে নাইডু ট্রফিতেও। কিন্তু খেলা হয়নি। উলটে হয়ে গেলেন অভিনেতা। এরকমই অদ্ভুত জীবন অভিনেতা ইরফান খানের। সাইকেল কিনবেন, তাই ১৫ টাকা মাইনেয় দুটি ছাত্র পড়িয়ে টাকা জমিয়েছেন। আবার ১৯ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে পারিবারিক ব্যবসাও সামলেছেন।
১৯৬৭ সালের ৭ জানুয়ারি রাজস্থানের জয়পুরে জন্ম। বাবার পারিবারিক ব্যবসা। ছোটো থেকেই পড়াশুনা নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নন তিনি। আসল আগ্রহ খেলায়। অথচ বাবা চান ছেলে ব্যবসা দেখুক। মায়ের ইচ্ছা, ছেলে পড়াশুনা করে ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হোক। কিন্তু এমন একটা জীবন চাননি ইরফান। কোনোমতে রাজস্থান কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। ততদিনে অভিনয়ের পোকা নড়েছে মাথায়। অভিনয় করলেন 'জ্বলতি বদন' নামে এক নাটকে। নিজের অভিনয় দক্ষতা দেখাতে বাড়ির লোককেও ডেকে আনলেন। নাটকের শুরুর দৃশ্য ছিল – ইরফান ড্রিঙ্ক করছেন, ট্রানজিস্টারে গান চলছে। গান থামলে হাতের গ্লাস ছুঁড়ে দেবেন ট্রানজিস্টারের দিকে। কিন্তু মঞ্চে হল এক কাণ্ড। গান আর থামে না। অগত্যা পরিচালকের ইশারায় তিনি গ্লাস ছুঁড়লেন, ট্রানজিস্টারটি আসল ছিল না। গ্লাস তার মধ্যে দিয়ে চলে গেল, গান থামল না। এমন নাটক দেখে ভরসা পাননি ইরফানের অভিভাবকেরা। এদিকে ততদিনে হাতে এসে গেছে। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা বা এনএসডি-র ফর্ম। অগত্যা মাকে মিথ্যা বললেন – এই কোর্স করলে জয়পুর ইউনিভার্সিটিতে লেকচারারের চাকরি পাওয়া যেতে পারে। আবার এনএসডি-র ফর্ম ফিলআপ করতে গিয়েও আরেক বিপদ। অন্তত দশটি নাটকের নাম লিখতে হবে অভিজ্ঞতায়। অগত্যা বানিয়ে বানিয়ে লিখে দিলেন কিছু নাম।
আরও পড়ুন
প্রয়াত অভিনেতা ইরফান খান, ৫৩ বছর বয়সেই শেষ হল যাত্রা
আসল যুদ্ধ শুরু হল এনএসডি থেকে বেরিয়ে। অভিনয় করতে চাইছেন, অথচ সুযোগ নেই কোনো। এদিকে প্রচণ্ড অর্থাভাব। অনেক সময় মনে হয়েছে – আর নয়, ফিরে যাই। এমন সময়ে পাশে ছিলেন এক বন্ধু। সুতপা শিকদার। দিল্লির প্রবাসী বাঙালি। আলাপ এনএসডি থেকেই। মূলত তার সাহসেই হাল ছাড়েননি ইরফান। মুম্বইয়ে পিজি শেয়ার করেছেন, জল খেয়েও কাটাতে হয়েছে এক-এক দিন। ততদিনে গোবিন্দ নিহালনি-র বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করে ফেলেছেন। ইবটসেনের 'লিটল ইয়লফ' অবলম্বনে রচিত 'জজির', ট্রিন্ডবার্গের 'ফাদার' অবলম্বনে রচিত 'পিতা'। পরে সেগুলি টেলিভিশনে দৃশ্যায়িত হয়েছে। সুযোগ পেলেন গোবিন্দ নিহালনি-র 'দৃষ্টি'তে। সহ অভিনেতা ডিমপল কাপাডিয়া, শেখর কাপুর। এখান থেকেই শুরু হয় চলচ্চিত্র অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখা…
জীবন সহজ ছিল না কোনদিনই। কিন্তু এই লড়াই তাঁকে থামাতে পারেনি। পয়সার জন্য দিনের পর দিন বিভিন্ন স্টুডিওয় গিয়েছেন অডিশনের জন্য, অসংখ্য বার রিজেকশনের মুখোমুখি হয়েছেন। তবু চেষ্টা ছাড়েননি। অভিনয় করেছেন – চাণক্য, ভারত–এক খোঁজ, ডর ইত্যাদি বিভিন্ন টিভি সিরিয়ালে। থিয়েটারের ছেলে – শুরুতে ক্যামেরা, লাইট বুঝতে অসুবিধা হত। বকুনি খেতেন বারবার। এমনও হয়েছে, সারাদিন অভিনয় করার পর সন্ধ্যায় চেক নিতে গিয়ে অর্ধেক টাকা পান। সঙ্গে উত্তর পান – “যা অভিনয় করেছ তাতে এই যথেষ্ট।”
আরও পড়ুন
প্রকাশ্যে এল ‘৯০ সালে ইরফান খান অভিনীত শর্ট ফিল্ম, জড়িয়ে এফটিটিআই-এর বাঙালিরাও
চলচ্চিত্রে সুযোগ আসে 'সালাম বম্বে' দিয়ে। ব্যস, আর পিছন ফিরে তাকাননি। এরপর একে একে 'রোগ', 'লাইফ ইন এ মেট্রো', 'পান সিং তোমর', 'পিকু','লাঞ্চ বক্স', ও আরও অসংখ্য সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি। হলিউডে ও কাজ করেন 'এ মাইটি হার্ট ', স্লামডগ মিলিওনেয়ার', 'অ্যামেজিং স্পাইডারম্যান', 'লাইফ অফ পাই' ছবিতে।
নিজের অভিনয় নিয়ে কখনও সন্তুষ্ট হতেন না তিনি। ভালো অভিনয় করার ইচ্ছা, নিজেকে ভেঙেচুরে নতুন কিছুর খোঁজ আজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে তাঁকে। তিনি জানতেন অভিনয় -ই তাঁর একমাত্র পথ। টেলিভিশনের ধারাবাহিকের গতানুগতিক অভিনয়ে বিরক্ত হয়েছেন, বিমর্ষ হয়েছেন – তবু হাল ছাড়েননি। জানতেন সুযোগ আসবে। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন – “ম্যায় তো কাফন বাঁধকে আয়া থা।” এই অদম্য লড়াই ছিল ইরফান খানের শক্তি। যে শক্তিতে অসুস্থ অবস্থাতেও অভিনয় করেন তাঁর শেষ ছবি 'আংরেজি মিডিয়াম'-এ।
আরও পড়ুন
স্ত্রী বাঙালি, কাজ করেছেন বাঙালি পরিচালকদের সঙ্গেও; হয়ে উঠেছিলেন বাংলার আপনজন
চলে গেলেন ইরফান খান। রেখে গেলেন দুই সন্তান ও স্ত্রী সুতপা শিকদারকে। মাত্র চারদিন আগেই মাতৃহারা হয়েছিলেন। অসুস্থ ছিলেন, ভর্তি হন মুম্বাইয়ের লীলাবতী হাসপাতালে। মায়ের শেষকৃত্যেও থাকতে পারেননি তিনি। ক্রিকেটার হতে চাওয়া মানুষটা নিজের জীবনের ইনিংসে বড় তাড়াতাড়ি দাঁড়ি টেনে দিলেন…