ভেঙে যাওয়া সেতু আর অভিনয়ের ভাসমান স্রোত সশব্দে আঙুল তুলে দেয় মুখে। শুদ্ধ আগুনে পুড়ে আরো ভালোবাসতে ইচ্ছে করে ভৈরবী স্বপ্নদের। আমি ছাড়া তো কেউ আর বসে থাকে না আমার জন্য। নবনীতা দেবসেনের (Nabanita Devsen) কবিতা জন্ম দেয় সেই ‘প্রথম প্রত্যয়’-এর। শুধু কবিতাই-বা বলি কেন, গল্প-উপন্যাস-ভ্রমণ কাহিনি সর্বত্র হাত ধরে নেয় তাঁর নির্ভার আলোর প্রকাশ।
চিনতে কিছুটা দেরি হয়ে যায়। আশেপাশে মুখ তুলে বৃষ্টির ছায়া খুঁজতে গিয়ে চাতকপাখির কাছে রামধনু দেখে ফেলার মতো। নিজের কবিতা সম্পর্কেও তো একই বিবৃতি দেন তিনি। পিতা নরেন্দ্র দেব, মা রাধারাণী দেবী—এর মাঝে কবি হয়ে ওঠাটা কি কম ঝক্কির ব্যাপার? লোকে তো বিশ্বাসই করতে চায় না যে ছোট্ট মেয়েটির কলমেও আছে কবিতার জাদুকাঠির স্পর্শ। মন খারাপ হয়। বন্ধুরাও মনে করে বাড়িতে মা লিখে দিয়েছে কবিতা। সেই যেবার ‘নদী’ কবিতা লেখার জন্য ‘কুমারী’ নবনীতা প্রথম পুরস্কার পেল, সেবার সুনির্মল বসু পর্যন্ত কানে কানে বলেছিলেন, “কে লিখে দিল, বাবা না মা?” হতে পারে রসিকতা, তা বলে একজনের আনন্দ মাটি করে দেওয়ার অধিকার কি কারো আছে? তারপর কলেজবেলায় ক্লাসে বসেই লিখে ফেলা আস্ত একটি কবিতা। অনেকেই তাতে শুনতে পেল রাধারাণী দেবীর ঝংকার।
না, কোথাও একটা অসুবিধা হচ্ছে তো বটেই। ‘বারো’ বছর বয়সে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকাতে প্রকাশিত কবিতা সম্বন্ধেও মনে হয়েছিল একই কথা। তারপর ঝড়-বৃষ্টিতে কত পর্দা উড়ে গেল, শুকনো পাতায় ভিজে গেল শৈবালদল। যৌবনের প্রাকলগ্নে ‘দেশ’ পত্রিকায় বেরোল ‘চলচ্চিত্ত’। মায়ের দেওয়া নাম। বড্ড প্রিয়। নিজে রবীন্দ্রনাথের মতো করে নাম দিয়েছিলেন ‘রাতের রেলগাড়ি’। মা বদলে দিলেন। নিজেও অসংখ্যবার কাটাকুটি করতেন লেখার উপরে। ‘পারফেক্ট’ না হলে কিছুতেই মন বসে না। খোঁজ চলত নিজের কবিতার ভাষার। শুধু আঙ্গিকে বা শব্দের মাহাত্ম্যে নয়, সন্ধান নিজস্ব বোধের। যে চেতনায় জন্ম হয় ‘সই’দের, যে বিশ্বাসে রূপকথার রাজকন্যারা উদ্ধার করে নিয়ে আসে রাজপুত্রদের।
তারপর একদিন বড়ো হয়ে ওঠা। বাংলার বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গ, বাড়িতে প্রথিতযশা মানুষদের আগমন, প্রেসিডেন্সি কলেজ আর বন্ধুদের আড্ডায় পৌঁছে যাওয়া নতুন বৃত্তে। “একটা জীবন ভাঙতে ভাঙতে অন্য জীবন গড়ছি না কি?” অবশেষে একা একা বিদেশে পড়তে যাওয়া। টুকরো টুকরো কাগজে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। কিছু হারায়, কিছু লেখা থাকে খাতার শেষ পাতায়। নিজের সঙ্গে যুদ্ধে প্রস্তুত করে নেওয়া কবিতাকে। তার মধ্যে আছে ‘মহিলা কবি’ নামক পরিচয়টিকে সজোরে ছুঁড়ে মারার স্পর্ধা। কখনও তো কাউকে আদর্শ বলে মেনে চলতে চাননি। সেই সুযোগও ছিল না বাংলা কবিতার পরিসরে। পাঠকের কাছে তো রাজলক্ষ্মী দেবী, কবিতা সিংহ, নবনীতা দেবসেন—সবই এক। যেন সকল ‘মহিলা কবি’-ই আসলে একজন। তাদের বিরুদ্ধেই রাখলেন একবাক্যের দৃপ্ত ঘোষণা, “কবিতার প্রত্যেকটি লাইনেই কবির পাসপোর্ট সাইজ ফোটোগ্রাফ আঁকা থাকে।”
আরও পড়ুন
বিচ্ছেদের পরেও, জন্মদিনের লেখায় অমর্ত্যকে নবনীতা বলছেন - 'Treat this article as flowers...'
বিদেশে পড়তে গিয়ে বোধহয় আরো বেশি করে মনে হয়েছে কথাটা। সিমোন দ্য বোভেয়ারের ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’, বেটি ফ্রিডানের ‘দ্য ফেমিনিন মিস্টিক, জার্মেন গ্রিয়ারের ‘ফিমেল ইউনাখ’ যাই বলা হোক না কেন, কোথাও গিয়ে পশ্চিমী একটা টান থেকেই যায়। দক্ষিণ এশিয়ার নারীর সমস্যার সঙ্গে কি সম্পূর্ণভাবে খাপ খায় সেই তত্ত্ব? ভারতীয় নারীবাদের ধারণা কোথায়? তাই বোধহয় শরৎচন্দ্রের ‘নারীর মূল্য’-এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারেন না তিনি। বার্কলেতে পোস্ট-ডক্টরেট করার সময় জড়িয়ে পড়েন ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন কিংবা নারীমুক্তি আন্দোলনে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘোষণা করা হল, ক্যাম্পাসে সরকারবিরোধী কোনো প্রতিবাদসভা আয়োজন করা যাবে না। তাতেই যেন আগুন পড়ল বারুদে। হাজারো ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে সেখানে নবনীতা। ভিতরে গিটার বাজিয়ে গান গাইছেন জোন বেজ, ‘উই শ্যাল ওভারকাম’। আর বাইরে সশস্ত্র পুলিশ। শান্তিপূর্ণ অবস্থান করে গ্রেপ্তার হতে চায় ছাত্রছাত্রীরাও। যদিও শেষ পর্যন্ত নেতৃবৃন্দের প্রস্তাবে সরে যেতে হল নবনীতার মতো বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের। একবার পুলিশে ধরলে ফেলোশিপ, পড়াশোনা সব বন্ধ হয়ে যাবে। চোখের সামনে ৮০৬ জনকে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ বাহিনী।
আরও পড়ুন
যুগে-যুগে রামায়ণ লিখেছেন যে সাহসিনীরা, তাঁদের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন নবনীতা
তখন ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চায় অল্পস্বল্প হাত পাকালেও, পরে সরে এসেছেন সে পথ থেকে। কিন্তু দেশ-বিদেশের সঞ্চয়ে ভরে উঠছে কবিতার গাছগাছালি। প্রেম-বিবাহ-বিচ্ছেদ সব তো আসলে সেই ভেঙে ফেলা সেতুদের ছোটো ছোটো স্মারক। প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাত ভর করে অনুচ্চারিত কোনো সংক্রামিত অসুখ। যে পায়রার দল একরত্তি ঘুলঘুলিতে বসে আপন মনে বুনে যায় ঘর-সংসার, তার সঙ্গে যোজনব্যাপী দূরত্ব তৈরি করতে গিয়ে হারিয়ে যেতে হয় অচেনা রথের মেলায়। বাসন-কোসন, কাপ-পিরিচকে বাঁচাতে গিয়ে ঘরটাই ভেঙে যায় নিজেদের অজান্তে। তাই বোধহয় দুঃখ তাড়া করা মেয়েটার জন্য একটা আশ্রয় খুব প্রয়োজন। যেখানে সদা হাসিমুখে ‘ভালোবাসার বারান্দা’য় বসে একার সঙ্গে গল্প করতে পারেন নবনীতা।
Powered by Froala Editor