মুছে গেল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের প্রাচীনতম ভাষা ‘সারে’, করোনা কেড়ে নিল শেষ বক্তার প্রাণ

মূলত ছ’টি ভাষা পরিবারের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায় ভারতে। ইন্দো-আরিয়ান, দ্রাবিড়, টিবেতো-বর্মান, অস্ট্রো-এশিয়াটিক, তাই-কাদাই এবং গ্রেট আন্দামানিক। করোনা মহামারীর মধ্যেই মুছে গেল গ্রেট আন্দামানিক ভাষা পরিবারের প্রাচীনতম ভাষা ‘সারে’। চলে গেলেন সারে ভাষার শেষ বক্তা লিচো।

গ্রেট আন্দামানিজ ভাষা মূলত নেগ্রিট এবং ওগান ভাষার সংমিশ্রণে গঠিত। যদিও এই ভাষায় মিশে আছে আন্দামানের প্রাচীন চারটি ভাষা— জেরো, সারে, খোরা এবং বো। এর আগে ২০১০ সালে আন্দামান নিকোবর থেকে মুছে গিয়েছিল খোরা এবং বো। সারে ভাষার একমাত্র বক্তা ছিলেন লিচো। তিনি ছিলেন রাজা জিরাকের প্রথম সন্তান। বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। ৪ এপ্রিল লিচোর মৃত্যুর সঙ্গেই মৃত্যু হল ভাষাটির। চিরতরে হারিয়ে গেল সারে। 

করোনা ভাইরাসের থাবা ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের বাইরেও কায়েম হয়েছে ছোট্ট এই দ্বীপপুঞ্জে। ইতিমধ্যেই আন্দামানে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৩ জন। আঞ্চলিক অনেকেই দাবি করেছেন, তাঁর শরীরে কোভিড-১৯ এর লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। তবে লিচোর মৃত্যুতেও করোনার সংক্রমণের রহস্য ছিল কিনা, তা পরিষ্কার নয় এখনও। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরেই তিনি ভুগছিলেন যক্ষ্মা এবং হৃদরোগে। 

একমাত্র প্রাচীন গ্রেট আন্দামানিজ ভাষা হিসাবে এখন বেঁচে রইল ‘জেরো’। মাত্র তিনজন অধিবাসী বাঁচিয়ে রেখেছে এই ভাষাকে। তবে তিনজনই পঞ্চাশোর্ধ। আক্রান্ত নানান রোগে। প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসায়, ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন যেকোনো সময়ে। করোনা আবহে প্রাচীন এই ভাষাটির অস্তিত্বও বেশ সংকটে।

এই দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ওঙ্গে এবং জারোয়া আদিবাসী সংস্কৃতি। এই দুই সম্প্রদায় মিলিয়ে রয়েছেন ৬৭০ জন সদস্য। তাঁদের ভাষা ‘আং’ পরিবারের। এছাড়াও উত্তর সেন্টিনাল দ্বীপে বসবাস করেন প্রায় ৫০ জনের আদিবাসী গোষ্ঠী। বহির্জগতের যোগাযোগ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন তাঁরা। নিজেদের দ্বীপের কাছাকাছি অন্য কারোর উপস্থিতিই পছন্দ করেন না তাঁরা। তাই তাঁদের ভাষার ব্যাপারে কোনো সূত্রই পাওয়া যায়নি আজ অবধি। 

আন্দামানি আদিবাসীদের সঙ্গে জিনগত সাদৃশ্য দেখা যায় আফ্রিকানদের। রয়েছে ভাষাগত কিছু মিলও। ধারণা করা হয় আফ্রিকা থেকেই প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে দক্ষিণ এবং দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় পরিযায়ন করেছিলেন তাঁরা। ছড়িয়ে পড়েছিলেন অস্ট্রেলিয়া এবং নিউ গিনিতেও। তাই তাঁদের ভাষায় কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস লুকিয়ে আছে। ভাষার ব্যাকরণগত গঠনও আধুনিক ভাষার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। হয়তো আন্দামানিজ উপভাষাগুলি এশিয়ার প্রাচীনতম ভাষা। লিখিত নথি না থাকায় এর সঠিক তথ্য কেউ-ই দিতে পারেন না। ভাষাবিদরা মনে করেন, এই ভাষাগুলির মধ্যেই তাই লুকিয়া আছে বিবর্তনের তথ্য।

আন্দামানে ১৭৫৫ সালে প্রথম উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে ডেনমার্ক। কিন্তু এই দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীরা প্রথম পৃথিবীর সামনে আসেন ১৮৫৮ সালে। ব্রিট্রিশরা যখন ফৌজদারী উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। তখন ৮০০০ অধিবাসীর বসবাস ছিল গোটা দ্বীপপুঞ্জে। কিন্তু ঔপনিবেশিকদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই আন্দামানে প্রবেশ করে নানান রোগের জীবাণু। ছড়িয়ে পড়ে সিফিলিস, যক্ষ্মা এবং অন্যান্য নানা রোগ। লিচোর জন্মের সময় ১৯৬০ সালে গ্রেট আন্দামানিজ ভাষার বক্তা হিসাবে জীবিত ছিলেন ১৯ জন। বাকিরা তার আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন রোগাক্রান্ত হয়ে। এই ১৯ জনের মধ্যেই আর তিনজন অবশিষ্ট রয়েছেন এখন। বাঁচিয়ে রেখেছেন জেরো ভাষাকে।

তবে ‘সারে’ ভাষা পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে গেলেও লিচোর কাজের মধ্যে দিয়েই তার অস্তিত্ব রয়ে গেছে খানিকটা। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের শিক্ষাদপ্তরে কাজ করতেন লিচো। ভাষাবিদ অনবিতা আব্বিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন সারে ভাষার। এই ভাষার ব্যাকরণের নিয়ম এবং অভিধান তৈরিতে সাহায্য করেছিলেন লিচো। অনবিতা আব্বির সেই গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছিল ২০১৩ সালে। একমাত্র এই গ্রন্থই ইতিহাসের দলিল হয়ে ‘সারে’ ভাষার নথি বাঁচিয়ে রাখল। কিন্তু কথা বলার রইল না কেউ-ই।

 পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবী থেকে প্রতি দু’সপ্তাহে হারিয়ে যায় একটি করে ভাষা। তেমনই হারিয়ে গেল সারে। প্রাচীনতম ভাষার অবলুপ্তি নীরবেই প্রত্যক্ষ করল ভারত। ভারতে এই মুহূর্তে বিপন্নপ্রায় ভাষার সংখ্যা ১৯৭টি। যেগুলির প্রত্যেকটির বক্তার সংখ্যা ১০ হাজার জনেরও কম। এই তালিকাতেই রয়েছে আন্দামানের ক্ষীণ হয়ে বেঁচে থাকা অন্যতম প্রাচীন ভাষাগুলিও। আন্দামানের জনগোষ্ঠীগুলি মূলত প্রকৃতির গায়ে ঘেঁষেই বেঁচে থাকে। বাইরের রোগ এবং দূষণে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারাই। 

২০০২ সালে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর আজো বন্ধ হয়নি আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড। ক্রমাগত বেড়েছে পর্যটন। ফলে দূষণ জনিত কারণে শ্বাসরোগে আক্রান্ত হন অনেকেই। আর এখন করোনার সংক্রমণ। কোভিডের হানায় আমাজনের মতোই জীবনসংকট দেখা দিয়েছে এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যেও। করোনার আবহে আন্দামানে বন্ধ রাখা হয়েছে অনুপ্রবেশ। গোষ্ঠীগুলিকে যথাসম্ভব বোঝানো হয়েছে প্রথাগত উৎসব থেকে বিরত থাকার জন্য। কিন্তু কতটা কাজ হবে তাতে? বাকি পৃথিবীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়লেও চিকিৎসার অভাবে অবলুপ্তির পথে হাঁটতে পারে এই সংস্কৃতি। 

সংক্রমণের আগে থেকেই কি আমরা সতর্ক হতে পারতাম না একটুও? হাজার হাজার বছরের প্রাণোচ্ছল এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব কি বর্তায় না আমাদের উপর? সারে ভাষার অবলুপ্তি এই প্রশ্নগুলোর সামনেই বারবার কাঠগড়ার দাঁড় করাচ্ছে ‘সভ্যতা’কে...

Powered by Froala Editor

More From Author See More