২৫ মার্চ, মধ্যরাত। ঢাকা শহর শুনশান। প্রত্যেক বাড়ির আলো নিভে গিয়েছে। ঠিক এমন সময়ে সেনা ব্যারাকের দরজা খুলে গেল। ঝাঁকে ঝাঁকে সশস্ত্র সেনা বেরিয়ে এল রাজপথে। বন্দুকের গুলির শব্দ প্রথমে একটা দুটো। তারপর সমস্ত আকাশ কাঁপিয়ে। একে একে দরজায় ধাক্কা। কাদের খুঁজছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী? বাঙালিদের। ঢাকা শহরের যাঁরা প্রকৃত বাসিন্দা।
‘অপারেশন সার্চলাইট’। হ্যাঁ, এই নামেই সেই ভয়ঙ্কর রাতকে মনে রেখেছে ইতিহাস। আজ থেকে ৫০ বছর আগের এক রাত। কিন্তু কেন এমন হল? আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল ভিতরে ভিতরে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তৈরি করেছিল নিখুঁত ব্লুপ্রিন্ট। অন্যদিকে অবশ্য স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান। তবে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা কেউই জানতে পারেননি। অন্যদিকে আওয়ামী লিগের সমস্ত পরিকল্পনাই জেনে গিয়েছিল পাকিস্তানি সেনা।
দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। নির্বাচনের ফলাফলে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লিগ। এমন ঘটনায় অবাক হয়েছিল সারা পৃথিবী। একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড, আর মাঝে ভারত পেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তান। এখানেই বাঙালিদের বাস। আওয়ামী লিগ পশ্চিম পাকিস্তানে একটিও আসন না পেলেও পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লিগ।
তবে নির্বাচনে জয়লাভের পরেও মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রীসভা গঠন করতে দিতে চাইলেন না প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা ততদিনে বাঙালিদের তাঁদের ক্ষমতাভুক্ত জাতি বলে মনে করেছে। তারাই যদি সরকার গঠন করে, তাহলে প্রকৃত পাকিস্তানিদের ক্ষমতা কী হবে? প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পরিকল্পনায় বসলেন দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো। প্রস্তাব দেওয়া হল, পাকিস্তানের দুটি ভূখণ্ডে দুটি পৃথক সরকার গঠন হবে। কিন্তু পৃথক সরকারই যদি হয়, তাহলে পৃথক রাষ্ট্র নয় কেন? বাঙালিরা তখন এই প্রশ্নই তুললেন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকা এলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।
আরও পড়ুন
খিদে মেটাত মাটির তৈরি বিস্কুট ‘ছিকর’, প্রচলন ছিল প্রতিবেশী বাংলাদেশেই
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধৈর্য ধরে থাকতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু দফায় দফায় আলোচনার পরেও কোনো সমাধানসূত্র বেরিয়ে এল না। ৭ মার্চ বিরাট জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনার কথা জানালেন। অন্যদিকে মার্চের মাঝামাঝি ঢাকায় এসে উপস্থিত হলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। পরিকল্পনা ছিল, ভুট্টো রাজি হলেও ইয়াহিয়া খান মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রিসভা গঠনের অনুমতি দিতে রাজি হবেন না। আর এর মধ্যে গোপনে সেনা ব্যারাকে ঘাঁটি গাড়বে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা।
২৫ মার্চ বিকালে পশ্চিম পাকিস্তান রওয়ানা হলেন ইয়াহিয়া খান। আর মধ্যরাতেই শুরু হল অপারেশন সার্চলাইট। একে একে বাঙালিদের হত্যা করা শুরু হল। এই এক রাতে অন্তত ১ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনা। আর অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সেনাদের থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গিয়েছে। গ্রেপ্তার হলেন বঙ্গবন্ধু। তবে ২৬ মার্চ জেলখানা থেকেই ঘোষণা করলেন, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উত্খাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।’ ২৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন পূর্ব পাকিস্তানের সেনা আধিকারিক মেজর জিয়াউর রহমান।
আরও পড়ুন
দুর্গার পাশেই বঙ্গবন্ধুর ছবি, ১৯৭১-এর পুজো ও এক মুসলমান ‘দেবতা’র গল্প
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমানে সেনা এসে ঘিরে ফেলল ঢাকা সহ ১৬টি শহর। ইয়াহিয়া খান ভেবেছিলেন, সপ্তাহ খানেক অভিযান চালালেই বাঙালিদের কাবু করা যাবে। কিন্তু সেদিন সীমানা ভুলে বাঙালি তাদের ক্ষমতা দেখিয়ে দিয়েছিল। কলকাতা থেকেই কাজ করতে শুরু করল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। টানা ৭ মাস ধরে যুদ্ধ চলল। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে সামরিক সমর্থন জানালেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ১৬ অক্টোবর ভারত-বাংলাদেশ ‘মিত্রসেনা’-র কাছে পরাজয় স্বীকার করল পাক বাহিনী। অবশেষে বিজয়ী হলেন বাঙালিরাই। ২৬ মার্চ যে রক্তক্ষয়ী লড়াই শুরু হয়েছিল, তা পূর্ণতা পেল ৭ মাস পর। বিজয় দিবসের দিনে। আজ সেই ঐতিহাসিক লড়াই ৫০ বছরে পা দিল।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ঢাকায় নিহত বঙ্গবন্ধু; পিতৃহারা শেখ হাসিনাকে দিল্লিতে আশ্রয় দিলেন প্রণব-দম্পতি