বিগত দুই দশকে পদার্থবিদ্যার রহস্য উন্মোচনে বড়ো ভূমিকা নিয়েছে সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। এই যন্ত্রের উপর ভিত্তি করেই আবিষ্কৃত হয়েছে একাধিক মৌলিক কণা। মাস খানেক আগেও নতুন চারটি বিস্ময়কর কণার সন্ধান দিয়েছিল এলএইচসি। এবার এই যন্ত্রের পরীক্ষার ওপরে ভিত্তি করেই, সনাতন পদার্থবিদ্যার দিকে আঙুল তুললেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের দাবি, প্রকৃতিতেই লুকিয়ে রয়েছে অজানা এক ধরণের বল। এবং সেই বলের সম্পর্কে কোনো রকম ধারণা দিতে ব্যর্থ সনাতন পদার্থবিদ্যা।
কিন্তু কেন এমন দাবি বিজ্ঞানীদের? সনাতন পদার্থবিদ্যাকে কেন অস্বীকার করছেন বিজ্ঞানীরা? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে ৬ বছর। ২০১৪ সালের কথা। সার্নের বিজ্ঞানীরা সন্ধান পেয়েছিলেন বিশেষ এক ধরণের ‘বিউটি কোয়ার্ক’-এর। এই কোয়ার্কের বিশেষত্ব হল, তার অস্বাভাবিক ক্ষয়।
পদার্থবিদ্যার কণাতত্ত্বের আধুনিকতম মডেলে মৌলিক কণা হিসাবে ধরা হয় মূলত দু’ধরণের কণাকে— কোয়ার্ক এবং লেপটন। ২০১৪ সালে বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন এক অদ্ভুত ঘটনা। তা হল, বিউটি কোয়ার্কের ক্ষয় হয়ে তৈরি হচ্ছে মিউয়ন কণা। যা পারতপক্ষে একটি লেপটন। ভর প্রায় ইলেকট্রনের ২০০ গুণ। তবে সেখানেই থেমে থাকছে না ক্ষয়ীভবনের প্রক্রিয়া। মিউয়ন ভেঙে পুনরায় তৈরি হচ্ছে ইলেকট্রন।
এই ফলাফলই ইঙ্গিত দিচ্ছিল, কোনো গোলযোগ রয়েছে সনাতন মডেলে। বিগত ৬ বছর ধরেই তাই চলেছে দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সংগ্রহ করা হয়েছে নতুন নতুন নানা রাশির বিস্তারিত তথ্য। লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের সাম্প্রতিক সেই তথ্যই যেন সমর্থন জানাচ্ছে বিজ্ঞানীদের সন্দেহকে। হ্যাঁ, অজানা কোনো বলের উপস্থিতিই এই ঘটনার জন্য দায়ী।
আরও পড়ুন
আবিষ্কৃত চারটি নতুন কণা, বদলাবে পদার্থবিদ্যার তত্ত্বও
আরেকটু বিষদে বলা যাক বিষয়টিকে। গবেষকরা জানাচ্ছেন, প্রতি ১০০টি মিউয়ন ক্ষয়ের মধ্যে ৮৫টি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এই অসঙ্গতি। আর সেই ফলাফলের প্রবণতা ৩ সিগমা। অর্থাৎ, প্রতি ১০০০ বার পরীক্ষায় ফলাফল বদলেছে মাত্র ১ বার। তবে এই অ্যানোমালি-র পরিমাণ ৫ সিগমা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে কোনো পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন না গবেষকরা।
আরও পড়ুন
সূর্যের ‘সি-এন-ও’ চক্র থেকেই নির্গত হয় নিউট্রিনো কণা, অবশেষে মিলল প্রমাণ
আপাতত এই ফলাফলের উপর ভিত্তি করেই একটি তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন তাঁরা। ‘স্ট্রং’, ‘উইক’, তড়িৎচুম্বকীয় এবং মহাকর্ষ— এই চার ধরণের বলের অস্তিত্বের ব্যাপারে অবগত আমরা। বিষয় হল এই চার ধরণের বলই কার্যকরী হয় কোনো না কোনো মৌলিক কণার মাধ্যমে। তবে বিউটি কোয়ার্ক এবং মিউয়ন ক্ষয়ের জন্য দায়ী নতুন একটি মৌলিক কণা। যার নাম ‘জেড প্রাইম’। এই কণা সম্পূর্ণ অজানা এক ধরণের বলের বাহক। ‘উইক ফোর্স’-এর থেকেও যা দুর্বল। এবং এই বলের প্রভাব অত্যন্ত সামান্য বলেই তাকে উপেক্ষা করে যাওয়া হয়েছে পর্যবেক্ষণ থেকে। ফাঁক রয়ে গেছে সনাতন মডেলের তত্ত্বে। আর সেই জন্যই হয়তো একাধিক আশ্চর্যজনক কণার আবিষ্কারের প্রেক্ষিতে পাওয়া যাচ্ছে না যুক্তিসঙ্গত কারণ।
আরও পড়ুন
‘মেসন’ কণার ধারণা দিয়েও নোবেল পাননি বিজ্ঞানী দেবেন্দ্রমোহন বসু
এক কথায় এই অজানা বল বৃহত্তর একটি পাজলের ছোট্ট একটি না পাওয়া টুকরো। সনাতন মডেলে তার প্রতিস্থাপন চেহারাটাই পাল্টে দিতে পারে পদার্থবিদ্যার ধারণার। যুগান্তকারী এই আবিষ্কারেই শিহরিত বিজ্ঞানীরা। যদিও এখনও হাতে-নাতে প্রমাণ মেলার আগে পর্যন্ত পাল্টাচ্ছে না কণাতত্ত্বের আদি মডেল। তবে আগামীতে নতুন দিগন্তের সন্ধান পেতে চলেছে বিজ্ঞান, সে ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী গবেষকরা…
Powered by Froala Editor