সমাজের বুকে থেকেও যেন সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন তাঁরা। অধিকাংশেরই নেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, নেই ‘কর্মী’-র স্বীকৃতি, ও। সেই সঙ্গে তাঁদের নির্যাতন, হেনস্থার শিকার হতে হয় প্রতিদিনই। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে যৌনকর্মীদের নিয়ে। শুধু ভারত নয়, গোটা পৃথিবীর মানচিত্রেই তাঁদের ছবিটা কম-বেশি একইরকম। আর তাঁদের অধিকার নিয়ে যাঁরা সরব হয়েছেন? সমাজকর্মীদের মধ্যে সবথেকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন যৌন এবং এলজিবিটি অধিকার কর্মীরা। সম্প্রতি এমনটা চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে আনল আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট।
গত বৃহস্পতিবার, যৌনকর্মীদের অবস্থান এবং তাঁদের অধিকার নিয়ে কর্মরত সমাজকর্মীদের প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করে অলাভজনক সংস্থা ‘ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডারস’। সেখানেই উঠে আসে, বিশ্বব্যাপী সমাজকর্মীদের মধ্যে সবথেকে বেশি নির্যাতন এবং হিংসার শিকার হন যৌন-অধিকারকর্মীরা। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিষিদ্ধপল্লিগুলিতে তদন্তের মাধ্যমেই এই রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে আয়ারল্যান্ডের সংস্থাটি।
‘ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডারস’-এর রিপোর্ত অনুযায়ী তানজানিয়া, মায়ানমার, এল সালভাদোর, কিরজিস্তানের মতো দেশগুলির পরিস্থিতি সবথেকে ভয়ঙ্কর। শুধুমাত্র যৌনকর্মীদের অধিকারের পক্ষে সওয়াল হওয়ার জন্য অবমাননাকর কটূক্তি তো বটেই, যৌন হেনস্থা, শারীরিক নির্যাতন এমনকি কখনও কখনও প্রাণহানির সম্মুখীনও হতে হয় অধিকারকর্মীদের। এমনকি হিংসার শিকার হন সংশ্লিষ্ট কর্মীদের পরিবারের সদস্যরাও। তাছাড়াও মানবপাচার এবং যৌনকর্মীদের ওপরে নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ্যে আনলে অনেকক্ষেত্রে ‘ভিকটিম’-কেও তার দাম দিতে হয় প্রাণ দিয়ে।
আশ্চর্যের বিষয় হল, শুধুমাত্র মাফিয়া কিংবা পাচারকারীরাই নয়, এই সহিংসতার সঙ্গে জুড়ে থাকে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রশাসনও। সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে উঠে আসছে, মায়ানমার, তানজানিয়ায় ঘটেছে প্রশিক্ষণরত অধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তারের ঘটনাও। আর তাতে সক্রিয় মদত ছিল দেশের ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলের। শুধু যৌন অধিকারকর্মীরা নয়, একই হিংসার সম্মুখীন হন এলজিবিটি-কর্মীরাও। অধিকার আন্দোলনের বিষয়টিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমকামিতা’র বিজ্ঞাপন হিসাবেই দেখেন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশের প্রশাসন। এমনকি সাধারণ মানুষের রোষের মুখেও পড়তে হয় তাঁদের। বেসরকারি অলাভজনক সংস্থাগুলি বিসমকামীদের সমকামীতে পরিণত করছে, এমন প্রচারও চালায় ক্ষমতাশীল দল।
আরও পড়ুন
গার্হস্থ্য হিংসা রুখতে পাঠ্যপুস্তকে বদল, মহিলাদের জন্য বিশেষ আদালতও গড়ছে কেরালা
‘ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডারস’-এর এই রিপোর্টে বেশি করে উঠে এসেছে সাব-সাহারান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির কথা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এই প্রেক্ষিতে ভারতের পরিস্থিতিটাই বা কেমন? কলকাতার মানবাধিকার সংগঠন প্রান্তকথার কর্ণধার বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায় জানালেন, “যেকোনো হিউম্যান রাইটসের লড়াই একটু এগিয়ে লড়া যায় যদি সে-দেশে গণতন্ত্র থাকে। রিপোর্টে আক্রান্তদের তালিকায় শীর্ষে যে দেশগুলি রয়েছে সেখানে গণতন্ত্র নেই। যদিও ভারতের পরিস্থিতিটা খুব একটা ভিন্ন নয়। আসলে এই ভায়োলেন্সের অন্যতম কারণ হচ্ছে স্বীকৃতির অভাব। ভারতের ক্ষেত্রে সমকামিতা ডিক্রিমিনালাইজড হলেও, সিভিক রাইটসের ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এলজিবিটি’র মধ্যে বিশেষ করে ট্রান্সজেন্ডারদের ওপর আক্রমণের বিষয়টা রিপোর্টে আরও বেশি করে বলা হয়েছে। তাঁদের ক্ষেত্রে ভিসিবিলিটি একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ। সামাজিক স্বীকৃতি না থাকায়, তাঁদের ওপর আক্রমণ করলে পার পেয়ে যাওয়া যাবে, এই জায়গাটা এই আক্রমণগুলিকে উৎসাহ দেয়। ভারতে ট্রান্সজেন্ডার প্রোটেকশন আইন প্রণয়ন হলেও, সেই আইনে কোনো সাজাই ২ বছরের অধিকতর নয়। ফলে আইপিসির চোখে, এই সবকটা ধারা জামিনযোগ্য। কার্যত, একজন পুরুষ কিংবা মহিলা যে অধিকার পাচ্ছেন, সেটা একজন ট্রান্সজেন্ডার পাচ্ছেন না। এই আইন অনেকটাই পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আইন। সার্বিকভাবে অপরাধকে কোথাও যেন প্রশ্রয়ই দেওয়া হচ্ছে।”
আরও পড়ুন
জাতীয় উদ্যান সংরক্ষণের দায়িত্বে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের তরুণরা
বাস্তব পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হওয়া সত্ত্বেও, যৌন অধিকার কর্মীদের অবস্থা নিয়ে এর আগে কোনো রিপোর্টই প্রকাশ করেনি কোনো আন্তর্জাতিক সংগঠন। এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জও যেন খানিকটা উদাসীন এই বিষয়ে। সাম্প্রতি এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পরই রীতিমতো সাড়া পড়ে গেছে আন্তর্জাতিক স্তরে। নতুন করে আইন প্রণয়নের কথাও আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। কিন্তু লাল ফিতের জাল ছাড়িয়ে কবে বাস্তবায়িত হবে সেই কাজ, তা অজানা সকলের কাছেই…
আরও পড়ুন
বিশ্ব এক-চতুর্থাংশ নারীই গার্হস্থ্য যৌন হিংসার শিকার : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
Powered by Froala Editor