বিপর্যস্ত সামুদ্রিক পরিবেশ, জনসচেতনতা গড়ে তুলতে সাঁতারই হাতিয়ার লুইসের

লুইস উইলিয়াম গর্ডন পিউ (Lewis William Gordon Pugh)। নামটা অনেকেরই চেনা। ২০১৮ সালে কম-বেশি সমস্ত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেই চর্চায় উঠে এসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ সাঁতারুর নাম। সে-বছর বিশ্বের প্রতিটি মহাসাগর এবং সাতটি পৃথক পৃথক সমুদ্রে দীর্ঘ-দূরত্ব সাঁতার সাঁতার কেটে তৈরি করেছিলেন এক নতুন বিশ্বরেকর্ড। এমনকি আজও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ‘এনডিউরেন্স সুইমার’-দের (Endurance Swimmer) তালিকাতে শীর্ষস্থানেই দেখা যায় তাঁর নাম। 

তবে সাঁতারের জগতের বাইরে আরও একটি পরিচয় রয়েছে তাঁর। লুইস একজন স্বঘোষিত সমুদ্র আইনজীবী। অর্থাৎ, তিনি সমুদ্রের পরিবেশগত পরিস্থিতি ও বাস্তুতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করেন বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে লুইস রাষ্ট্রপুঞ্জের শাখা সংস্থা ‘ইউএনইপি’-র (UNEP) থেকে পান ‘প্যাট্রন অফ দ্য ওসান’ তকমা। ১৬ দিন ধরে সাঁতরে পেরিয়েছিলেন লোহিত সাগরের ১২৩ কিলোমিটার দূরত্ব। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় দেশের প্রতিনিধিত্ব না-করে কেন এনডিউরেন্স সুইমিং-কেই বেছে নিয়েছিলেন লুইস? 

দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে লুইসের জন্ম ১৯৬৯ সালে। সমুদ্র তীরবর্তী এই শহরে বেড়ে ওঠায় শৈশব থেকেই সাঁতারে আগ্রহ ছিল লুইসের। দুটি ভিন্ন ভিন্ন মহাসাগর এসে মেশে এই অঞ্চলে। ফলে কেপ টাউনের সমুদ্র বেশ অশান্ত। সেখানে সাঁতার কাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবে শৈশব থেকে এই বিপজ্জনক জলরাশিকে জয় করার নেশাই একপ্রকার চেপে বসেছিল তাঁর মধ্যে। ফলে সাধারণ সাঁতার প্রতিযোগিতার থেকে তাঁকে বেশি করে আকৃষ্ট করে এনডিউরেন্স সুইমিং। তবে সাঁতরে বিশ্বের সপ্তসিন্ধু, পঞ্চ মহাসাগর জয় করবেন— এমনটা কোনোদিনই পরিকল্পনায় ছিল না তাঁর। বরং, সেই চিন্তাভাবনা আসে আরও পরে। 

নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে সামুদ্রিক দূষণের বাড়বাড়ন্ত নজর কাড়ে লুইসের। খেয়াল করেন, একদিকে যেমন সমুদ্রই হয়ে উঠেছে প্লাস্টিক বর্জ্যের আস্তানা, তেমনই মানুষের কার্যকলাপে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে প্রবালপ্রাচীর। বিপর্যস্ত হচ্ছে বাস্তুতন্ত্র। এমনকি স্রেফ অবলুপ্ত হয়েছে বেশ কিছু প্রজাতিও। যে-সমুদ্রের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সাঁতারকে বেছে নিয়েছিলেন, সেই সমুদ্রই এভাবে প্রাণ হারাবে— সেটা মেনে নিতে পারেননি লুইস। তাই জনসচেনতা গড়ে তুলছে হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন সাঁতারকেই। 

২০০৭ সালে আর্কটিক অঞ্চলে বরফের গলনকে চর্চায় তুলে আনতে উত্তর মহাসাগরে সাঁতারে নামেন লুইস। এর পরের বছর দক্ষিণ মহাসাগরে দীর্ঘ দূরত্ব সাঁতরে পার হন অবৈধ মৎস্যশিকার সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য। ২০১০ সালে হিমালয়ের হিমবাহ গলনের প্রতিবাদে লুইস সাঁতার কেটেছিলেন হিমশীতল পার্বত্য হ্রদেও। তাছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য বিভিন্ন সাগর-ও তিনি জয় করেছেন সামুদ্রিক দূষণ এবং বাস্তুতন্ত্রের বিপর্যয়কে আলোকিত করার জন্য। বিশেষ করে বিশ্বের যে-যে অঞ্চলে দূষণ প্রবল, সেই জায়গাগুলোকেই নিজের সাঁতারের ট্র্যাক হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন লুইস। 

তাতে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন নজরে না-পড়লেও লাভ হয়েছে বিস্তর। ২০১৮ সালে ৩০ শতাংশ সমুদ্রকে সংরক্ষিত ঘোষণা করার দাবিতে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন তিনি। ২০৩০ সালের মধ্যেই এই কাজ শেষ করার দাবি মেনে নেয় আন্তর্জাতিক একাধিক সংস্থা। পাশাপাশি লুইসের অনুপ্রেরণায় সামুদ্রিক জঞ্জাল সাফ করতে ময়দানে নামে বহু আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। বলতে গেলে, পরোক্ষভাবে যেন সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের এই বৃহত্তর আন্দোলনকেই নিঃশব্দেই পরিচালিত করে চলেছেন লুইস পিউ। সেক্ষেত্রে তাঁর নামের পাশে ‘সামুদ্রিক আইনজীবী’ কথাটা বসলে, ভুল হয় না এতটুকু।

Powered by Froala Editor