মানব-অঙ্গের নিখুঁত ছবি আঁকতে, শব ব্যবচ্ছেদও করেছিলেন দ্য ভিঞ্চি!

প্রযুক্তির উন্নতি আজ অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে চিকিৎসক কিংবা গবেষকদের কাজ। একদিকে মানুষের অনুপস্থিতিতেই যেমন অস্ত্রোপচার করছে রোবট, তেমনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রই মানুষের অভ্যন্তরীণ দেহের ছবি তুলে ধরছে স্ক্রিনে। কিন্তু আজ থেকে ৫০০ বছর আগেই মানুষের শরীরের অভ্যন্তরীণ ছবি চিকিৎসকদের সামনে তুলে ধরেছিলেন কিংবদন্তি শিল্পী, বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। 

অ্যানাটমি বা আধুনিক শরীরবিদ্যার জনক হিসাবে পরিচিত বেলজিয়ামের শরীরবিদ আন্দ্রেয়াস ভেসালিয়াস। তবে আন্দ্রেয়াসের জন্মেরও আগে অ্যানাটমি (Anatomy) নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা ও নথিপত্র তৈরি করে ফেলেছিলেন লিওনার্দো (Leonardo Da Vinci)। 

মানব শরীরের বাহ্যিক প্রতিকৃতি আঁকতে গোটা ইতালিতে জুড়ি মেলা ভার ছিল লিওনার্দোর। কিন্তু শরীরের ভেতরটা কেমন? কোনো চিকিৎসকের কাছেই সঠিক বর্ণনা পাননি তিনি। সেই অনুসন্ধানে শেষ পর্যন্ত নিজেই মাঠে নামেন লিওনার্দো। ঠিক করেন শব ব্যবচ্ছেদ (Autopsy) করে এই রহস্যের সমাধান করবেন তিনি। তবে পুরনো শব হলে চলবে না। সদ্য-মৃত ব্যক্তি লাগবে তাঁর। এমন শর্তে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন ইতালির প্রশাসনিক নেতারাও। শেষ পর্যন্ত সেই ব্যবস্থা হয় ফ্লোরেন্সে। শতায়ু এক প্রবীণ ব্যক্তি দেহদান করতে রাজি হন। 

হ্যাঁ, ফ্লোরেন্সে পাড়ি জমিয়েছিলেন লিওনার্দো। তারপর মুমূর্ষু ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা। সেটা ১৫০৭ কি ১৫০৮ সাল। শুধু শতায়ু ব্যক্তিটির দেহ ব্যবচ্ছেদই নয়, তাঁর মৃত্যুর কারণও চিহ্নিত করেছিলেন ভিঞ্চি। প্রথমবারের জন্য উল্লেখ করেছিলেন লিভার সিরোসিসের কথা। করোনারি ধমনীতেও তাঁর সমস্যার বিষয়টি নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। 

আরও পড়ুন
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির প্রতিভার রহস্য কি লুকিয়ে জিনেই, জানান দেবে উত্তরপ্রজন্ম

তবে দেহের অভ্যন্তরীণ ছবি আঁকার কাজে সেভাবে সফল হননি তিনি। কারণ, শীতকাল না হওয়ায় দ্রুত পচন শুরু হয়ে গিয়েছিল তাঁর শরীরে। কাজেই সাফল্যের জন্য অপেক্ষা করতে হল আরও বছর চারেক। ১৫১১ সালে ইতালিজুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে প্লেগ। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, আক্রান্ত হয়েছিলেন বহু চিকিৎসকও। লিওনার্দো তখন মিলানের নিকটবর্তী পাভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন অ্যানাটমি নিয়ে। তবে দুঃখের বিষয়, প্লেগে আক্রান্ত হলেন তাঁর সহকারী চিকিৎসক মার্ক-অ্যান্টোনিও ডেলা টোরে। সেটাও ছিল শীতকাল। ফলে, সহজে দেহ পচনের আশঙ্কা নেই। মার্ক-অ্যান্টোনিও-র মতামত নিয়েই তাঁর মৃত্যুর পর দেহ-ব্যবচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নিলেন লিওনার্দো। তবে নিজে হাতে ব্যবচ্ছেদ নয়। কীভাবে শব কাটতে হবে তা শিখিয়ে দিলেন তরুণ চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্রদের। নিজে ওপারেশন টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন খাতা-পেনসিল নিয়ে। সময় নষ্ট করা চলবে না এতটুকু। নাহলে যে পচন শুরু হয়ে যেতে পারে আবার। 

আরও পড়ুন
মোনালিসার হাসি কীভাবে এঁকেছিলেন ভিঞ্চি? পাঁচ শতক পরে সমাধান রহস্যের

হ্যাঁ, সফলভাবেই মস্তিষ্ক, খাদ্যনালী, ধমনী, পেশি এবং সুষুম্নাকাণ্ডের ছবি এঁকেছিলেন তিনি। তুলে ধরেছিলেন হৃদপিণ্ডের স্কেচও। দেহের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গের ছবি আঁকলেও কীভাবে পেশির আকার, আয়তন সঠিক অনুপাতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন ভিঞ্চি, তা রহস্যই থেকে গেছে। শুধুই কি কল্পনা? কারণ ব্যবচ্ছেদে পেশির আস্তরণকে আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করা এক প্রকার অসম্ভব আজও। তবে? বছর দুয়েক আগে একটি ভিন্ন গবেষণা জানায়, নানান রোগের ক্ষেত্রে বা বড়ো আঘাত লাগলে ফুলে ওঠে নির্দিষ্ট পেশি। তখন খালি চোখে বা স্পর্শ করে বোঝা যায় তাদের অস্তিত্ব। লিওনার্দো হয়তো সেই পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন পেশি চিহ্নিতকরণের কাজে। তবে ফুলে যাওয়া পেশির আকার দেখে তার আসল চেহারার ছবি আঁকাও দুরূহ ব্যাপার। সেখানেই বোধহয় লিওনার্দোর ম্যাজিক। 

তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, লিওনার্দোর তৈরি এই অ্যানাটমি তৎকালীন ইতালিতে চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত হলেও, পরবর্তী তা হারিয়ে যায় কালের নিয়মেই। উনিশ শতকে স্কটিস চিকিৎসাবিদ ও শরীরবিদ উইলিয়াম হান্টার গবেষণা করার সময় একটি পত্রিকায় লিওনার্দোর এই কাজের বিবরণ খুঁজে পান। তারপর শুরু হয় অনুসন্ধান। পুরনো ছবিগুলিকে যথাসাধ্য সংগ্রহ করে অনুকরণ তৈরি করেন তিনি। স্কটল্যান্ডের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে ‘অ্যানাটমি’-শীর্ষক একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করেছিলেন হান্টার। 

উনিশ শতকে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল সমকালীন সমস্ত অ্যানাটমির ছবির থেকেই বহু ধাপ এগিয়ে রয়েছে লিওনার্দোর আঁকা এই ছবিগুলি। আজ অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সময়ে দাঁড়িয়েও এই ছবিগুলিকেই সবচেয়ে সুষম এবং নিখুঁত বলে ধরে নেন গবেষকরা। চিকিৎসক না হয়েও লিওনার্দোর এই কাজ, একপ্রকার বিস্ময়ই বটে…

Powered by Froala Editor