তাঁকে ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন বলিউডের খলনায়ক! প্রয়াত কিংবদন্তি পোস্টার শিল্পী দিবাকর কারকারে

সময়টা আশির দশকের শেষদিক। নিজস্ব স্টুডিওতে রং-তুলি নিয়ে ব্যস্ত বিবাকর কারকারে। ঠিক এই সময় গোপনে তাঁর ঘরে ঢুকলেন একজন অভিনেতা। যে সিনেমার পোস্টারের কাজ করছেন দিবাকর, অভিনেতা সেই সিনেমাতেই খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। কিন্তু হঠাৎ এই সময় তাঁর কাছে কী প্রয়োজনে? একটু অবাক হয়েই অভিনেতার মুখোমুখি বসলেন দিবাকর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁর হাতে ২৫ হাজার টাকার একটি বান্ডিল গুঁজে দিলেন অভিনেতা। দাবি অতি সামান্যই। সিনেমার পোস্টারে যেন তাঁর মুখটা নায়কের চেয়ে খুব বেশি অনুজ্জ্বল না হয়।

বছর আটেক আগে একটি ইন্টারভিউতে এই ঘটনার স্মৃতিচারণা করেছিলেন দিবাকর কারকারে। হাসতে হাসতে তিনি বলেছিলেন, ঘুষ তিনি নেননি। কিন্তু পোস্টারে সেই খলনায়কের মুখটা বেশ স্পষ্টভাবেই এঁকেছিলেন। তবে সেই হাসির মধ্যেই জমে ছিল একটু বিষাদ। প্রায় ৩ দশক ধরে যে কাজে প্রায় একা রাজত্ব করেছেন তিনি, হঠাৎই নতুন প্রযুক্তি এসে সেই কাজ কেড়ে নিল। সেটা ১৯৯২ সাল। বলিউডের পোস্টার তৈরির জন্য সেই বছরই ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে এলেন পাবলিসিটি ডিজাইনার রাহুল নন্দ। ব্যাস্, মানুষের হাতে আঁকা পোস্টারের বদলে সেই ডিজিটাল পোস্টারই জনপ্রিয় হয়ে উঠল। চোখের পলকে কাজ হারালেন বহু মানুষ। কেউ কেউ জীবিকার প্রয়োজনে ড্রাইভিং বা কেয়ার-টেকিং-এর কাজ শুরু করলেন। কিন্তু দিবাকর কারকারে অন্য কোনো জীবকায় যোগ দিলেন না। যা সঞ্চয় ছিল, তাই নিয়েই বিদায় নিলেন বলিউডের রঙ্গমঞ্চের আড়াল থেকে।

৬০-এর দশকে সিনেমার প্রচারের জন্য দূরদর্শন বা অন্য কোনো মাধ্যম ছিল না। রেডিও সম্প্রচার করা হত। আর ছিল পোস্টার। সেইসব পোস্টার হত হাতে আঁকা। সিনেমার নানা দৃশ্য থেকে স্টিল ফটোগ্রাফ তুলে দেওয়া হত শিল্পীর হাতে। শিল্পী সেইসব দৃশ্যকে সাজিয়ে নিতেন নিজের মানসপটে। তারপর শুরু হত নতুন প্রেক্ষাপট আঁকার কাজ। ঠিক এইসময় মুম্বাই শহরে ব্যানার আঁকার কাজ করতেন দিবাকর কারকারে। তবে মনের মধ্যে ইচ্ছা ছিল, একদিন সিনেমার পোস্টার আঁকবেন। সেই সুযোগও এসে গেল অচিরেই। দিবাকর কারকারের হাতে প্রতিটা দৃশ্য যেন জীবন্ত হয়ে উঠত। আর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ছিল তাঁর আঁকার পদ্ধতি। রং-তুলির সঙ্গে তিনি ব্যবহার করতেন ধারালো ছুরি। আর পোস্টারে নায়ক-নায়িকার মুখও যেন হয়ে উঠত সেই ছুরির মতোই ধারালো।

সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল দিবাকরের আঁকা অমিতাভ বচ্চনের ছবিগুলি। সেই অ্যাংরি-ইয়ংম্যান মুখ আঁকার ক্ষমতা যেন আর কারোরই ছিল না। দিওয়ার, শোলে, অমর আকবর অ্যান্টনি, সুহাগ – তালিকা বেশ দীর্ঘ। ৩ দশকের কর্মজীবনে তিনি অন্তত ৫০ হাজার সিনেমার পোস্টার এঁকেছেন। সেই তালিকায় স্থান পেয়েছে বিমল রায়ের ‘বেনজির’ বা মনমোহন দেশাইয়ের ‘মর্দ’-এর মতো ব্লকবাস্টার সিনেমাও। দিবাকর কারকারের অধীনেই কাজ করতেন ৩০-৪০ জন শিল্পী। তারপর হঠাৎ সেই স্বপ্নের জগৎ ভেঙে পড়ল কাঁচের স্বর্গের মতো। একরাশ হতাশা বুকে নিয়ে বিদায় নিলেন দিবাকর কারকারে নিজেও। গত বুধবার রাত ৯টা ২০-তে ৮১ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। শুধু থেকে গিয়েছে তাঁর অসংখ্য কাজ। ইতিমধ্যে সেইসব পোস্টার আর্কাইভ করে রাখার কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। এইসব পোস্টারের সঙ্গে যে নস্টালজিয়া জড়িয়ে আছে, তার স্পর্শ কোনো প্রযুক্তিই পাবে না কোনোদিন।

Powered by Froala Editor

More From Author See More