মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন শ্যামল মিত্র, ভক্তদের জন্য গাইলেন বিশেষ গান

চল্লিশের দশক। তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। বাংলা তখন শুধু সামাজিক পরিবর্তনই দেখছে না; দেখছে রাজনৈতিক পরিবর্তনও। সেসবই দেখছে নৈহাটির তরুণ ছেলেটা। তিনি নিজেও যোগ দিয়েছেন আইপিটিএ-তে। মাঝেই মাঝেই বন্ধুবান্ধবরা চলে আসে নৈহাটির বাড়িতে। সবাই সংস্কৃতি জগতেরই লোক, আইপিটিএ-র।

এরকমই একদিনের কথা। খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমোতে গেছেন সবাই। গভীর রাত; হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল একজনের। চোখে-মুখে অস্থিরতা, সোজা চলে গেলেন ছেলেটির কাছে। কী ব্যাপার? না একটা নতুন গান মাথায় এসেছে। ঘুমের মধ্যেই গানটির ছোটো একটা অংশের সুর করে ফেলেছেন তিনি। একবার শুনবি? ব্যস, দুই বন্ধু মিলে শুরু হল গান তৈরি করার খেলা। গানটি ছিল ‘গাঁয়ের বধূ’। যার মাথায় সুর এসেছিল, তাঁর নাম সলিল চৌধুরী। আর যার বাড়িতে এই পুরো ব্যাপারটি ঘটল, তিনি? নৈহাটির ওই তরুণ ছেলেটির নাম শ্যামল মিত্র… 

বাবা ছিলেন নামী ডাক্তার, স্বয়ং বিধানচন্দ্র রায়ের ছাত্র। নৈহাটিতে ডাঃ সাধন কুমার মিত্রের নাম শুনলে সবাই কপালে হাত ঠেকান। আর বাবার ইচ্ছা, ছেলে যেন তাঁরই মতো প্রসিদ্ধ ডাক্তার হয়। কিন্তু শ্যামল মিত্রের যে স্বপ্ন অন্য জায়গায়! তিনি যে সুরের সন্ধান করে চলেছেন। গান ধরলে কোথায় যেন হারিয়ে যান! সাত সুরের এমন গোলকধাঁধা ঠিক পছন্দ হল না বাবার। গানবাজনা করে হবেটা কী? একটু মন দিয়ে পড়লেই তো বাবার আসনটা নেবে ছেলে! না, গান ছেড়ে শ্যামল কোথাও যাবেন না। অগত্যা, বাড়িছাড়া! পরে অবশ্য রাগ কমে যায় সাধন মিত্রের… 

বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের অন্যতম মাইলস্টোন শ্যামল মিত্র। তাঁর হাত ধরে একের পর এক অবিস্মরণীয় গানের সাক্ষী থেকেছি আমরা। একটা সময় শ্যামল মিত্রের রেকর্ড বার হওয়া মানেই ‘সেলিং লাইক হট কচুরি’! আর এমন জীবনের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে নানারকম গল্প। নৈহাটি থেকে কলকাতায় আসার পর সোজা চলে যান সুধীরলাল চক্রবর্তীর কাছে। রীতিমতো নাড়া বেঁধে গান গাওয়া শুরু। ধীরে ধীরে ‘গুরু’র সবকিছুই যেন ভালো লাগতে শুরু করল। 

১৯৪৯ সাল। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের পর একটা সুযোগ পেলেন শ্যামল মিত্র। ‘সুনন্দার বিয়ে’ সিনেমায় প্রথম প্লে-ব্যাক। রিহার্সাল ঠিকঠাকই হল। রেকর্ডিংয়ের দিন শ্যামলকে দেখে খানিক নাক কোঁচকালেন গায়িকা সুপ্রীতি ঘোষ। স্পষ্ট মদের গন্ধ বেরোচ্ছে যে! নেশা করে রেকর্ডিং করতে এসেছেন? একটু ঘাবড়ে গেলেন শ্যামল মিত্র। গুরু (পড়ুন সুধীরলাল চক্রবর্তী) বলল বলেই তো খেলাম; এতে নাকি ভালো গান হবে! 

একটা সময় শ্যামল মিত্রের গান শহরের রক অবধিও পৌঁছে গিয়েছিল। সুর হোক বা কণ্ঠ, প্রেমের গানে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। বিশেষ করে ‘দেয়ানেয়া’ মুক্তি পাওয়ার পর যেন অন্য জগতে চলে গেলেন তিনি। তখন চারিদিকে শিল্পীদের জোয়ার। মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমার… তালিকা বিরাট লম্বা। আর সেখানেই উজ্জ্বল তারা হয়ে থাকলেন শ্যামল মিত্র। তাঁদের মধ্যে যোগসূত্রটি ছিল একটিই— গান। একবার মান্না দে’র সঙ্গে গান নিয়ে আলোচনা চলছে। ‘রাজবংশ’ সিনেমার গান। কিন্তু সুরটা কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না মান্না দে’র। শুরু হল তর্ক। হঠাৎই রেগে গেলেন শ্যামল মিত্র। এভাবেই গানটা করুন, নয়তো আর গাইতে হবে না! এই কথার পর মান্না দে’ও চুপ। ওইভাবেই গানটি গাইলেন… 

আরও পড়ুন
গণনাট্য সংঘে আত্মপ্রকাশ সুরকার সলিল চৌধুরীর, সেখানেই নিষিদ্ধ হল তাঁর গান

এর মধ্যেই ঘটে গেল দুর্ঘটনা। ১৯৬৯ সালে গাড়ি করে বেরিয়েছিলেন শ্যামল মিত্র। আর তখনই ঘটে যায় অ্যাক্সিডেন্ট। গুরুতর জখম অবস্থায় হাসপাতালে, বাড়িতে কাটতে লাগল জীবন। আর কি ফিরতে পারবেন গানে? ভরসা জুগিয়ে গেছেন সহশিল্পীরা, সেইসঙ্গে ছিলেন বাংলার আপামর জনগণ। শ্যামল মিত্র এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারেন না। যানওনি। ফিরে এসে সেই ভক্তদের জন্যই গাইলেন বিশেষ গান। গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা সেই গানও হিট। ‘তোমাদের ভালোবাসা ফিরায়ে এনেছে মোরে মরণের পার থেকে’। আবার উদ্বেলিত হলেন ভক্তরা। ওঁরাই তো শ্যামল মিত্রকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন। আজও তিনি সেই জায়গাতেই আছেন। কিংবদন্তি, প্রেমের পাখি হয়ে…       

তথ্যসূত্র-
১) ‘গানের জন্য ছেলেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাবা’, সৈকত মিত্র, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘সে দিনের সোনা ঝরা সন্ধ্যা’, শঙ্করলাল ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘শ্যামল মিত্র’, নিউজ জি ২৪   

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
কার সুর বেশি ভালো, উৎপলা সেনের কাছে হাজির হলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ও শ্যামল মিত্র

More From Author See More