শুধুই পদার্থবিদ্যা নয়, বাংলার নদী-নালা নিয়েও দীর্ঘ গবেষণা করেছিলেন মেঘনাদ সাহা

বাংলা তো বটেই, গোটা ভারত তাঁকে চেনে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের ওপর তাঁর গবেষণা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিল। তিনি, বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। কিন্তু এসবের বাইরেও তাঁর একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের থেকে চোখ সরিয়েই রেখেছি আমরা। বাংলার নদী নালা এবং তার সংস্কার নিয়ে দীর্ঘ কাজ করেছিলেন তিনি। নানা সময় তাঁর সেই কাজ প্রকাশও পেয়েছে বিভিন্ন জায়গায়।

১৯৩২ সাল থেকে এই ব্যাপারে গবেষণা শুরু করেন মেঘনাদ সাহা। শুধু গবেষণা নয়, তাঁর ভাষায় ‘রীতিমত আন্দোলন’ও শুরু করেন তিনি। কেন? বিস্তর পড়াশোনা ও গবেষণার জন্য সব জায়গায় গিয়ে কথা বলেছিলেন তিনি। সেখানেই তিনি দেখেন সরকারি কর্মচারীদের দুরবস্থা। “আমাদের মূল বক্তব্য ছিল যে বাংলার নদীনালা দিয়া বৎসরে কত জলস্রোত প্রবাহিত হয়, দেশের উচ্চাবচতা কিরূপ ইত্যাদি বিষয়ে গভর্নমেন্টের সেচ-বিভাগের কোনো কর্মচারীদের কোনো ধারণা বা জ্ঞান নাই। কিরূপভাবে বর্ত্তমানে খাল ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে কাটা হয়, তৎসম্বন্ধেও তাহাদের কোনো জ্ঞান নাই”— এমন কথাই লিখেছিলেন তিনি। অথচ টাকা খরচ হচ্ছে, আর তা বেশ ভালো হচ্ছে। অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এই গোটা ব্যাপারটাতেই অত্যন্ত বিরক্ত ও হতাশ হয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা।

এই বিষয় বিভিন্ন চিঠিও আসতে থাকে তাঁর কাছে। বিশেষ করে দামোদর ক্যানাল এবং তার সমস্যা, রক্ষণাবেক্ষণের পদ্ধতি নিয়ে নানা সমস্যার কথাও শোনেন তিনি। বর্ধমানের সেচ ব্যবস্থার প্রবল অসুবিধার জন্য দামোদর ক্যানাল তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়াও বেশ কিছু ছোটো ছোটো নদী ও খালও অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু পরে সেই অবস্থা ভেঙে পড়ে। কিন্তু সেসবের দিকে তৎকালীন স্থানীয় প্রশাসন ও ব্রিটিশ সরকার কোনো নজরই দেয়নি। বিপুল টাকা খরচ করে দামোদর ক্যানাল তৈরি করা হলেও, সেটার কোনো যত্ন নেই। প্রয়োজনও কি খুব ছিল? চিঠিতে এমনই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসতে থাকে। একই প্রশ্ন ওঠে মেঘনাদ সাহার মনেও।

দামোদরের যাবতীয় ভরা মরসুম থাকে বর্ষাকালে। হেমন্তের শুরু থেকে প্রায় শুকিয়েই থাকে এই নদী। ফলে ক্যানালেও জল থাকে না। ফলে সমস্যার কোনো সমাধানও হয় না। এদিকে এর জন্য দেখা দিতে থাকে ম্যালেরিয়ার মতো রোগ। এদিকে সরকার নিরুত্তর। তাদের কোনো হেলদোল নেই। ঠিক এই অভিযোগই করে এসেছেন মেঘনাদ সাহাও। তাই তিনিও যুক্ত হন এই নদী আন্দোলনে। ১৯৩৫ সালে প্রশাসন তাঁর কথায় সায় দিলেও, হিসেব মতো বাজেট লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। ফলে সেটা করা সম্ভব হয়নি। যদি আগে থেকে সমস্ত গবেষণা ঠিকঠাক মতো করলে এত টাকা যে লাগত না, সেটাও জোর গলায় বলেছেন এই বিজ্ঞানী।

সেই সঙ্গে আরও একটা ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি। তাঁর লেখাতেই পাওয়া যায় সেই উল্লেখ- “বাংলা দেশের নদী-নিয়ন্ত্রণ ও খাল খননের জন্য তাঁহারা সাধারণত পঞ্জাব হইতে বিলাতী ও পাঞ্জাবী ইঞ্জিনিয়ার আমদানি করেন। ইহারা পাঞ্জাবের ব্যাপারে জানেন। কিন্তু বাংলার নদীনালার সমস্যা সম্পূর্ণ পৃথক। পঞ্জাবের ইঞ্জিনিয়াররা তাহা না বুঝিয়াই কাজ আরম্ভ করেন ও সরকারের বহু টাকা লোকসান হয়।” এই নিয়ে নিজেও অনুসন্ধান করেন। এবং তাঁর এই ধারণা যে অমূলক নয়, সেটাই প্রমাণ হয়। দুটি জায়গার ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য আছে। কাজেই সেখানকার মানুষরাই সবচেয়ে ভাল বুঝতে পারবে সেটা। বাংলার নদী নিয়ে কাজ বাঙালিরাই ভাল করতে পারবে। মেঘনাদ সাহার বক্তব্য ছিল - “বাংলার নদীনালার সমস্যা কখনও ইংরেজ বা পাঞ্জাবী ইঞ্জিনিয়ার দিয়া সমাধান হইতে পারে না, কারণ আরাম-কেদারা ছাড়িয়া দেশে গিয়ে জরিপ করা, বা তথ্য সংগ্রহ করার মতো ধৈর্য বা অবসর তাহাদের নাই। এই কাজের জন্য যে ইঞ্জিনিয়ার দরকার তাহা বাংলা দেশেই সৃষ্টি করতে পারি।”

এই কথাগুলো কি শুধু সেই ব্রিটিশ আমলের জন্যই প্রযোজ্য? এই মুহূর্তে নদীগুলোর দুরবস্থা আমরা নিজেরাই দেখতে পাই। খাল, নালা ইত্যাদির অবস্থা তো আরও শোচনীয়। অনেক নদী তো মুছেই গেছে বাংলা থেকে। বেশ কিছু নদী প্রায় খালেরই আকার নিয়েছে। আজও কি সাধারণ মানুষ এবং প্রশাসন সচেতন হয়েছে? একজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। তারপরও রাস্তায় নেমেছেন এই অবস্থা দেখে। আজ কি সেটা আমরা পারি না? অবস্থা যে আরও খারাপ!

ঋণ - প্রবাসী, পৌষ, ১৩৪৪

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More