বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ, শহরের পাশাপাশি খেলে বেড়াচ্ছে সুন্দর সতেজ ক্ষেত। তার মধ্যেই বেজে উঠছে যুদ্ধের আবহ। ভাষার জন্য লড়াই, স্বাধীনতার জন্য লড়াই। এভাবেই বাংলাদেশের পথ চলা। সে এক বিষম লড়াই; যার চালচিত্রে বেজে উঠেছিল দুরন্ত সব গান। সেইসঙ্গে ছিল আরও একটি গান— ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। রবি ঠাকুর লিখে গিয়েছিলেন বাংলার মাটিকে স্পর্শ করে। সেই গানটিতেই নতুন আবহ দিয়ে হাজির করালেন আরেক বাঙালি, সমর দাস। হয়ে উঠল একটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত। আজও বাংলাদেশের রেডিও ও টিভি খুললে যে সঙ্গীতটি স্বাগত জানায় সবাইকে। আর সেই কাজটিই করেছিলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি সুরকার, সঙ্গীতজ্ঞ সমর দাস…
গানটির আত্মার ভেতরের রবীন্দ্রনাথকে এতটুকুও খর্ব করেননি তিনি। বাংলার সনাতন মাটির গন্ধে কেবল ঢুকিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান। পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রার হাত ধরে সুরে ঢুকিয়েছেন সেই সময়ের চিত্র। আর তাতেই নতুন রূপে হাজির হল ‘আমার সোনার বাংলা’। সমর দাস ছিলেন এমনই। ছোটো থেকেই সুরে সুরে বেড়ে উঠেছিলেন। সঙ্গীত তাঁর জীবন থেকে অস্ত যায়নি। আর সেই সঙ্গীতকে হাতিয়ার করেই তিনি নেমে পড়েছিলেন লড়াইয়ের ময়দানে। মুক্তিযুদ্ধের গান, গণসঙ্গীত নিয়ে পৌঁছে গেছেন মানুষের দরবারে।
তখন এই বাংলার বুকের ওপর দিয়ে কোনো কাঁটাতার যায়নি। পাসপোর্ট না দেখিয়েই যাওয়া যেত কলকাতা থেকে ঢাকা। কিন্তু মাথার ওপর ছিল ব্রিটিশ শাসকদের ছড়ি। এমনই এক সময়, ঢাকায় এক বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম নিলেন সমর দাস। ছোটো থেকেই বাড়িতে সঙ্গীতের একটি পরিবেশ পেয়েছিলেন। বাবা জীতেন্দ্রনাথ দাসের ছিল বাদ্যযন্ত্রের দোকান। নিজে বেহালাও বাজাতেন ভালো। বাবার কাছেই সুরের পাঠ নেওয়া শুরু সমরবাবুর। কিন্তু এই ছেলে তো অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই শিখে নিচ্ছে যন্ত্রের সমস্ত পাঠ। ছোটবেলার বেহালা থেকে একটু একটু করে চলে গেলেন বাঁশি, পিয়ানো ও গিটারে। প্রাচ্য, পাশ্চাত্য সমস্ত রকম মিউজিকের ভেতরেই ডুব দিলেন তিনি।
পরিশ্রম ও সাধনার শেষে সুযোগও এল; এবং তা এল বেশ অল্প বয়সেই। ১৯৪৫ সালেই ডাক পেলেন অল ইন্ডিয়া রেডিও’র ঢাকা কেন্দ্রে। সুরকার হিসেবে নয়, বংশীবাদক হিসেবে। তখন মাত্র ১৬ বছরের কিশোর সমর দাস। ধীরে ধীরে তাঁর দক্ষতার কথা ছড়িয়ে পড়ে নানা জায়গায়। সময় এগোতে থাকে, আর সমরবাবুও জ্ঞান অর্জন চালিয়ে যেতে লাগলেন। এঁর তো কোনো শেষ নেই! ঢাকা থেকে একসময় চলে এলেন কলকাতা। রেডিওতে কাজ তো করলেনই, সেইসঙ্গে এইচএমভি’র যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবেও কাজ আরম্ভ করে দিলেন। ক্যানভাসটা আরও বড়ো হতে লাগল…
সময়টা এতক্ষণে খেয়াল করেছেন অনেকে। হ্যাঁ, তখন স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে দেশ। ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমের দুই অংশ ছিন্ন হয়ে তৈরি হল পাকিস্তান। পূর্ব বাংলা বদলে গেল পূর্ব পাকিস্তানে। তখনও সমর দাস কাজ করছেন কলকাতায়। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, কমল দাশগুপ্ত প্রমুখের সঙ্গে আড্ডায় সমৃদ্ধ হচ্ছেন। সেইসঙ্গে জীবনে হাজির হলেন আরও একজন মানুষ— সলিল চৌধুরী। ১৯৫০ সালে দুজনে একসঙ্গে কাজ করলেন ‘লটারি’ সিনেমায়। এই সালটি সমরবাবুর জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এতদিন তাঁর পরিচয় ছিল যন্ত্রশিল্পী হিসেবে। তাঁর প্রতিভায় আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন সকলে। তবে এবার সেই শরীরের ভেতরেই জন্ম নিল আরও এক সত্তা— সুরকার সমর দাস…
পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে নেমে পড়লেন সুর নির্দেশনার কাজে। ১৯৫৯ সাল। আব্দুল জব্বার খাঁয়ের পরিচালিত ‘মুখ ও মুখোশ’-এ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে এলেন সমর দাস। উল্লেখ্য, ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার পর এই সিনেমাটি বাংলাদেশে প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা ছবি। সময় এগোতে থাকে, আর ছবির কাজও বাড়তে থাকে। ১৯৬১ সালে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে যুক্ত হন তিনি। সুর সাধনাই তখন মুখ্য কাজ সমরবাবুর। তবে পরিস্থিতি যে বদলাচ্ছে, ভেতরে ভেতরে জমছে আগুন, সেটা কি টের পেয়েছিলেন?
আরও পড়ুন
গান গেয়ে প্রথম উপার্জন ২৫ পয়সা, সব ছেড়ে চাষবাস করার কথাও ভেবেছেন উদিত নারায়ণ
১৯৭০ সাল। আগুন ততদিনে জ্বলে গেছে পূর্ব পাকিস্তানে। পাকিস্তানি সেনা ও হানাদারের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ। ওঁরা নাকি বাংলাকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়! প্রাণ থাকতেও এমনটা হবে না। ২১ ফেব্রুয়ারির ভাইদের রক্ত ব্যর্থ হবে না। এমন সময় পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলে আছড়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড়। মৃত, ঘরছাড়া মানুষরা বসে আছে পথে। সরকারের কোনো হুঁশ নেই। এমন অবস্থায় দেশ বিদেশ থেকে শিল্পীরা এগিয়ে এলেন এই মানুষগুলোর জন্য। দেশের জন্য কেঁদে উঠলেন সমর দাসও। ঢাকা পল্টন ময়দানে আয়োজন করলেন ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ নামের সঙ্গীত অনুষ্ঠানের। ওই মানুষদের তো বাঁচাতে হবে। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তো এটাই সময়…
একদিকে দুর্যোগ, অন্যদিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী, যুবক, মহিলা, বৃদ্ধ। তৈরি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার দল। হিংস্র হয়ে উঠল পাকিস্তানের সেনারা। সেই নৃশংস অত্যাচারের বর্ণনা এখন আর নাই বা করা হল। রক্তে ধুয়ে গেল দেশের মাটি। সেই মাটি কপালে ঠেকিয়ে রাস্তায় নামল আরও মানুষ। ঠিক এটাই ছিল একজন সত্যিকারের শিল্পীর জেগে ওঠার মঞ্চ। জেগেইছিলেন সমর দাস। এবার প্রত্যক্ষভাবে পথে নামলেন। তিনি জানতেন, সরকারের বিপরীতে গেলে শুধু তাঁকে কেন, তাঁর পরিবারকেও ছাড়া হবে না। ঠিক করলেন, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে পাড়ি দেবেন সীমান্তের কাছাকাছি এক জায়গায়। কোনোক্রমে লুকিয়ে ছিলেন তাঁরা। কষ্ট লাগুক, কিন্তু এই কষ্ট বৃথা যাবে না…
তখন স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা চলছে। সেই দলে যোগ দিলেন সমর দাস। বেতারের প্রধান সঙ্গীত পরিচালকের ভূমিকা নিলেন তিনি। জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজগুলি এই সময় তৈরি করলেন। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘নোঙর তোলো তোলো’, ‘ভেবোনা গো মা তোমার’— এরকম অজস্র মুক্তিযুদ্ধের গান তৈরি করলেন সমরবাবু। রেডিওয়ে সম্প্রচারিত সেই গান ছড়িয়ে গেল তরুণদের বুকে। সবার মুখে মুখে সেই সুর। রক্ত গরম হয়ে উঠছে, চোখে তাঁদের নতুন সূর্য— যে সূর্যের নাম বাংলাদেশ…
আরও পড়ুন
কোপেনহেগেনে সেরার সেরা ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার’, বাংলা গানেই হৃদয় জিতলেন রুমা
যে স্বপ্ন একদিন ওপার বাংলার বাঙালিরা দেখেছিল, সেটা সার্থক হল। জন্ম হল বাংলাদেশের। জন্ম হল এক নতুন ইতিহাসের। দেশ তো তৈরি হল, এবার তো একটি জাতীয় সঙ্গীতের প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া সেই জায়গা আর কে-ই বা নিতে পারেন! সমর দাস খুঁজে নিলেন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি। কিন্তু এটি তো অনেকটা লোকগানের সুর। সেটাই কি থাকবে? নাকি মুক্তিযুদ্ধের সুরও ঢুকবে? সমরবাবুর মাথায় তখন নানা চিন্তা। কী করবেন তিনি? ঠিক করলেন, রবি ঠাকুরের মূল গান, সুর, স্বরলিপি সব এক রাখবেন। কেবল ভেতরে কিছু পাশ্চাত্য নোট ঢোকাবেন; যাতে গানটিতে অর্কেস্ট্রা ব্যবহার করা যায়। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের আবহটিও ফুটিয়ে তোলা যাবে। শুরু হল কাজ। সমরবাবু চলে গেলেন বিবিসি লন্ডনে। ‘আমার সোনার বাংলা’রই আধুনিক সুরবিন্যাস তৈরি করলেন তিনি। তৈরি হল জাতীয় সঙ্গীতের নতুন এক সংস্করণ। বিশ্বের বুকে নিজের পরিচিতি তৈরি করল বাংলাদেশ…
আজও বাংলাদেশের রেডিও ও টিভির দিন শুরু হয় এই বিশেষ সংস্করণটি বাজিয়ে। শুধু এখানেই থেমে থাকেননি সুরকার সমর দাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় যত গান তৈরি হয়েছিল, সেগুলোকে তো সংরক্ষণ করতে হবে। আবারও চলে এলেন কলকাতায়; নিজের পুরনো ডেরা এইচএমভি কোম্পানিতে। মুক্তিযুদ্ধের ২৬টি গান একত্রিত করে তিনি বের করলেন নতুন একটু রেকর্ড— ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’। পেয়েছেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সব সম্মান। দেশের শিল্পীরা যাতে অভাবে শেষ না হন, তার জন্য তৈরি করেন ‘বাংলাদেশ সঙ্গীত পরিষদ’। সবদিক থেকেই সমর দাস ছিলেন একজন পথিকৃৎ, একজন কিংবদন্তি। সমস্ত কাজ করলেন দুটো সত্তাকে মাথায় রেখে, দেশ এবং সঙ্গীত। এগুলো ছাড়া তো তিনিও অসম্পূর্ণ। ২০০১ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর চিত্তে বেজে গিয়েছিল লাল সূর্য, সবুজ ক্ষেত আর বাংলা গান…
তথ্যসূত্র-
১) ‘সমর দাস: বাংলার সঙ্গীত জগতের এক অসামান্য প্রবাদ পুরুষ’, অগ্নীশ্বর নাথ, রোর বাংলা
২) ‘সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সমর দাস’, সাহস ২৪
আরও পড়ুন
গণনাট্য সংঘে আত্মপ্রকাশ সুরকার সলিল চৌধুরীর, সেখানেই নিষিদ্ধ হল তাঁর গান
Powered by Froala Editor