আলোকে জানা মানে আরও বেশি করে অন্ধকারকে জানা – মনে করতেন তিনি। আলো আর অন্ধকারের যুগপৎ চলনকে এক সুতোয় গাঁথতেন। নিজে অন্ধকারে থেকেও আলোয় উজ্জ্বল করে রাখতেন মঞ্চ। তিনি দীপক মুখোপাধ্যায়। বাংলা নাট্যজগতের আলোকশিল্পীদের কথা বলতে গেলে প্রথম সারিতেই যাঁর নাম উঠে আসে।
শুরুটা হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। চেতনা নাট্যদলের ‘মারীচ সংবাদ’ নাটকের প্রযোজনার দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর উপর। নিজেই একাধিকবার বলেছেন, এর আগে আলো নিয়ে কোনোদিন আলাদা করে ভাবেননি। তাই দায়িত্ব পেয়েই প্রথমে ছুটে গেলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলে। নানান বইপত্র ঘেঁটে বুঝতে চেষ্টা করলেন আলোর রহস্য। তাছাড়া ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল দীর্ঘদিন ধরেই। তাই সব মিলিয়ে প্রাথমিক ধারণাটা তৈরি হয়েই গিয়েছিল। কিন্তু সেই ধারণাকে শিল্পের স্তরে নিয়ে যেতে গেলে নাটকের মর্মবস্তুকে স্পর্শ করা প্রয়োজন। আর সেটাই তাঁকে শিল্পীতে পরিণত করেছিল।
নাটকের সঙ্গে অবশ্য দীপকবাবুর যোগাযোগ বহু আগে থেকে। ১৯৫৮ সালে ১৬ বছর বয়সে পা রেখেছিলেন নাটকের মঞ্চে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শিবপুর শাখার সদস্য হয়ে সামনে থেকে দেখেছেন অনেক সফল নাটকের নির্মাণ। কিন্তু তখন সব কাজটাই হত সবাই মিলে হইহই করে। এর মধ্যে বিশেষভাবে কোনোকিছুকে অধ্যয়ন করার তাগিদ অনুভব করেননি। তাই পেশাদারভাবে নাটকে আত্মপ্রকাশ ১৯৭২ সালে চেতনা নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরেই। ‘মারীচ সংবাদ’ দিয়ে যে যাত্রা শুরু। তারপর একে একে জগন্নাথ, রোশন, তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, মেফিস্টো, পুতুলনাচের ইতিকথা ধরে দীর্ঘ যাত্রাপথ। প্রতিটা নাটকের সফল নির্মাণের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে তাঁর আলোক-ভাবনা।
নাটকের মধ্যে রাজনীতি তো শুধু কাহিনির ভিতরে থাকে না। নাটকের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটা মানুষ নিজের নিজের মতো করে সেই মর্মবস্তুকে ছুঁতে পারলে তবেই তা সফল হয়ে ওঠে। দীপক মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশে তাই কখনও কখনও গাছেরাও টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে থাকত। মঞ্চের চরিত্র ছায়া ফেলে ছড়িয়ে পড়ত সমস্ত গ্যালারিজুড়ে। সেখানেই দর্শকের সঙ্গে অভিনেতার দূরত্বটা ঘুচে যেত। শুধু তাই নয়, বাংলা নাট্যজগতে উইং থেকে আলো ফেলার চিরাচরিত রীতি ভেঙে উপর থেকে আলো ফেলার রীতি গড়ে তোলার পিছনেও তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আসলে মঞ্চের অভিনয় তো শরীরের অভিনয়। সেখানে শরীরের প্রতিটা ভাঁজের ওঠানামাকে আলোর মাধ্যমে ধরতে গেলে উপর থেকে একটা দ্বিমাত্রিক প্রেক্ষাপটে দেখাটা প্রয়োজনীয় ছিল। সেই তাগিদ থেকেই বদলে ফেলেছিলেন আলোকসজ্জার মূল ধারাটাই।
চেতনা নাট্যদলের পাশাপাশি কাজ করেছেন কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র নাট্যদলেও। দেখতে দেখতে বয়স বেড়েছে। শরীরও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ৭৯ বছর বয়সে এসেও কাজ করার ইচ্ছাটা কোনোদিন হারিয়ে ফেলেননি দীপকবাবু। তাঁর চিন্তার জগৎটাকেই যে ঘিরে রেখেছিল নাটকের মঞ্চ। কিন্তু বার্ধক্যজনিত অসুখ আর তাঁকে কাজ করতে দেয়নি। কিছুদিন আগেই নতুন রূপে মঞ্চে হাজির হল মেফিস্টো। পুরনো প্রযোজনার অনেকটাই বদলে গেল। মঞ্চে দেখা গেল না গৌতম হালদারকে। আর মঞ্চের পিছনেও নেই দীপক মুখোপাধ্যায়। গতবছর পর্যন্ত কাজ করে গিয়েছেন সমানভাবে। কিন্তু চলতি বছরে এসে শরীর একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। বিগত বেশ কয়েকদিন ধরে ভর্তি ছিলেন হাওড়ার একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে। শ্বাসকষ্টের কারণে ভেন্টিলেশনেও রাখতে হয় তাঁকে। আজ সকালেই কলকাতায় এসএসকেএম হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। আলো আর অন্ধকারের রসায়ন নিয়ে খেলতে খেলতেই আলোর জগৎ থেকে চির-অন্ধকারের জগতে পাড়ি দিলেন দীপক মুখোপাধ্যায়। বাংলা নাট্যচর্চার ইতিহাসে হয়তো আরও অনেকটা কাজ বাকি থেকে গিয়েছিল তাঁর।
তথ্যসূত্রঃ ১। আমাদের এখানে আলোকসজ্জার বিবর্তনের কথা যদি বলতে হয় সেটা একপ্রকার ছেলেখেলা - দীপক মুখোপাধ্যায়; সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহম দাস, প্রকাশিত - ভিন্ন সময়
২। নাটকের অন্তর্দেশের আলো, দীপক মুখোপাধ্যায়, সংবাদ প্রতিদিন
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কিশোর সেনগুপ্ত, সোহম দাস
Powered by Froala Editor