দেওয়ালে দাঁড় করানো একটা বোর্ড। ভয়াল দর্শন ছবি আঁকা সেখানে। উল্টোদিকে সাদা পাঞ্জাবী-ধুতি পরা মগনলাল মেঘরাজের হুকুম, ‘খিলা দিখানো হবে’। দেখাবে অর্জুন। ‘এক মিনিট, শরবতটা খেয়ে নিই’— জটায়ুর সেই কালজয়ী ডায়লগ। বোর্ডে হেলান দিতেই একের পর এক ছুরি ধেয়ে আসছে তাঁর দিকে। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর এই দৃশ্য প্রত্যেক বাঙালির একান্ত আপন। কিন্তু সত্যজিৎ রায়, সন্তোষ দত্ত ছাড়াও এই পুরো দৃশ্যের মূল কাণ্ডারি বা ভরকেন্দ্র ছিলেন আরও একজন। যিনি না থাকলে, এই দৃশ্য অক্ষত অবস্থায় শেষ হতই না। তিনি, অভয় মিত্র। উত্তরপাড়ার বাসিন্দা এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, কিংবদন্তি জাগলার নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
পাড়ায় গেলে অভয় মিত্র বললেই লোকে চিনিয়ে দেবে বাড়ি। আরও ভালো হয়, ‘লাঠি দা’ বলে ডাকলে। এটাই তাঁর ‘ডাকনাম’। বাবা কালোসোনা মিত্রের কাছ থেকেই ছোটো বয়সে জাগলিংয়ের পাঠ নেওয়া। কিন্তু বাবাকে বেশিদিন কাছে পাননি। তবে চর্চা থামেনি, বরং বেড়েই গেছে প্রতিটা দিন। আর কে না জানে, প্র্যাকটিস মেকস পারফেক্ট! নিজের খেলায় অভয় মিত্র ছিলেন জাদুকর। জাগলিংয়ের সমস্ত কিছু নখদর্পণে ছিল তাঁর। সেইসঙ্গে ছিল এই শিল্পটার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা।
পি সি সরকার জুনিয়রের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। বন্ধুত্বও ছিল অভিন্ন হৃদয়ের। দুজনেই যে সম্মোহন জানতেন; মাধ্যমটা নেহাত একটু আলাদা ছিল। স্টেজে উঠলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকতেন সবাই। সেই একই অবস্থা হয় সত্যজিৎ রায়েরও। একদিন অভয় মিত্রকে নিয়ে সোজা বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে চলে যান পি সি সরকার জুনিয়র। তখন ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিটির পরিকল্পনা চলছে। আর তার জন্য একজন জাগলারের প্রয়োজন; যে থাকবে ক্যামেরার পেছনে, কিন্তু যার অব্যর্থ নিশানা দর্শকদের মাতিয়ে রাখবে। সত্যজিতের প্রশ্ন ছিল ঠিক তিনটি— ছোরা ছোঁড়ার খেলা দেখাতে পারবে কিনা; জাগলিং করতে পারবে কিনা; ওই মুহূর্তে সত্যজিৎকে এই সবটা করে দেখাতে পারবে কিনা। প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর একই ছিল, ‘হ্যাঁ’।
দু’ধাপে হয়েছিল এই পরীক্ষা। ওইদিন বাড়িতেই সত্যজিৎ, বিজয়া ও সন্দীপ রায়কে জাগলিংয়ের বিভিন্ন খেলা দেখান। সত্যজিৎ রায় রীতিমতো চমকে ওঠেন। একটাই শব্দ বেরিয়ে আসে মুখ থেকে, ‘ওয়েল ডান!’ পরের পরীক্ষাটি একটু ঝুঁকির ছিল। অভয় মিত্রকে নিয়ে ইন্দ্রপুরীর স্টুডিওতে হাজির হন সত্যজিৎ রায়। সেখানেই রাখা ছিল বিখ্যাত সেই বোর্ডটি। হঠাৎ সত্যজিৎ নিজেই দাঁড়িয়ে পড়লেন বোর্ডের সামনে। তারপর শুধু একটাই কথা- ‘ছোঁড়ো!’ স্টুডিও’র বাকিদের অবস্থা সিনেমার ফেলুদা, তোপসে’র মতো। পরখ করে খুশি হয়েছিলেন তিনি। বাকিটা তো ইতিহাস। পর্দায় কামু মুখোপাধ্যায় অর্জুনের রোলটি করলেন; আর পেছন থেকে অব্যর্থভাবে ছুরিগুলো ছুঁড়লেন অভয় মিত্র! তৈরি হল বাংলা সিনেমার অমর দৃশ্যের একটি।
পরে ‘ফটিকচাঁদ’, ‘গুপি বাঘা ফিরে এল’-তেও তাঁর জাগলিং আমরা দেখতে পাই। বিশেষ পরিচয় ছিল মাদার টেরেসা’র সঙ্গে। তাঁর একান্ত স্নেহভাজনও ছিলেন। জীবনে পেয়েছেন বহু সম্মান। অবশ্য গোটা জীবনে লক্ষ্য ছিল একটাই, এই মাদারির খেলা যেন তাঁর মৃত্যুর পরও টিকে থাকে। সন্তানদের শিখিয়েছেন, নাতি-নাতনিদেরও শিখিয়েছেন। কিন্তু দুঃখ ছিল একটাই, এখনকার প্রজন্ম খুব বেশি এখানে আসছে না। জাগলিং অ্যাকাডেমিও শুরু করেছিলেন, কিন্তু সাড়া পাননি তেমন। সেই চিন্তা নিয়েই চলে গেলেন ‘লাঠি দা’ অভয় মিত্র। গোটা উত্তরপাড়া আজ শোকস্তব্ধ। রিষড়া শ্মশানে ততক্ষণে বিলীন হয়ে গেছেন ‘লাঠি দা’।