সর্বোচ্চ সংখ্যক গ্র্যামির অধিকারী তিনি, প্রয়াত কিংবদন্তি জ্যাজ সঙ্গীতশিল্পী চিক কোরিয়া

ল্যাটিন জ্যাজের জগতে তখন মঞ্চ কাঁপাচ্ছেন ডিজি গিলেসপি, স্ট্যান গেটেজ, মঙ্গো সান্তামারিয়া, সারা ভন প্রমুখ তারকা। যে সময়ের কথা হচ্ছে, সেটা ষাটের দশক। তবে এই ঈশ্বরতুল্য তারকাদের ভিড়েও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন এক তরুণ যুবক। তাঁর বয়স তখন সবেমাত্র কুড়ির কোঠায়। স্বনামধন্য তারকাদের সঙ্গে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শকদের বিস্মিত করে দিতেন সেই মার্কিন যুবক। পিয়ানোর রিডে ঝড় তুলতেন মেলোডির। চিক কোরিয়া। সম্প্রতি তিনি ইতি টানলেন মিউজিক্যাল নোটের সেই লম্বা দৌড়ে। শেষ হল জ্যাজ মিউজিকের একটি দীর্ঘ অধ্যায়।

গত মঙ্গলবার ফ্লোরিডার ট্যাম্পা শহরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কোরিয়া। বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। গতকাল তাঁর পরিবার এবং ব্যবস্থাপক ড্যান মিউজ নিশ্চিত করেন তাঁর মৃত্যুসংবাদ। দীর্ঘদিন ধরেই বিরল ক্যানসারে ভুগছিলেন বলেই মিউজ উল্লেখ করেন কোরিয়ার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে। অথচ বোঝা যায়নি বিন্দুমাত্রও। গত বছরও দু’-দুটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছিলেন তিনি। একইসঙ্গে। করেছেন বেশ কিছু মঞ্চ উপস্থাপনাও। শারীরিক যন্ত্রণাকে যেন নিশ্চুপেই সঙ্গীতের আড়ালে ঢেকে রেখেছিলেন কিংবদন্তি জ্যাজ সঙ্গীতকার।

বোস্টনের কাছেই চেলসি শহরে চিক কোরিয়ার জন্ম ১৯৪১ সালের ১২ জুন। তবে খাতায় কলমে তাঁর নাম তখনও আর্মান্দো অ্যান্টনি কোরিয়া। বাবা ছিলেন বোস্টনের একটি জ্যাজ ব্যান্ডের লিডার এবং ট্রাম্পেটবাদক। তিনি নিজেও চাইতেন, তাঁর সন্তান পেশা হিসাবে বেছে নিক জ্যাজ সঙ্গীতকেই। তখন মাত্র ৪ বছর বয়স কোরিয়ার। হাতেখড়ি হল সঙ্গীত প্রশিক্ষণের। তবে ট্রাম্পেটের বদলে তিনি বেছে নিলেন পিয়ানোকে। 

প্রাথমিকভাবে বাবার ব্যান্ডেই শুরু পেশাগতভাবে পিয়ানোবাদন। তবে তাঁর হাতের জাদু নজর কেড়েছিল গিলেসপি, সারা ভনের মতো তারকাদের। সেখান থেকেই শুরু হয় এক অন্য অধ্যায়। তবে নিজের পরিচয় গোপন করতে মাসির দেওয়া ডাকনাম ‘চিকি’কেই বেছে নেন তিনি। সামান্য বদল করে ‘চিক কোরিয়া’ নামেই করতে থাকেন মঞ্চ উপস্থাপনা। 

পরবর্তীকালে মাইলস ডেভিস, হার্বি হ্যানককের মতো শিল্পীদের সঙ্গেও কাজ করেছেন চিক কোরিয়া। ১৯৬৮ সালে ‘মাইলস ডেভিস গ্রুপ’-এর প্রকাশিত অ্যালবাম ‘ইন আ সাইলেন্ট ওয়ে’, ‘বিচেস ব্রিউ’-এর অন্যতম অংশ ছিলেন তিনি। বলা যায়, এই দুটি অ্যালবামই মাইলস্টোন তৈরি করে দিয়েছিল জ্যাজ দুনিয়ায়। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। 

পরবর্তীতে নিজে তৈরি করেন দুটি জ্যাজ গ্রুপ— ‘সার্কেল’ এবং ‘রিটার্ন টু ফরএভার’। তাছাড়াও গ্যারি বার্টন এবং হ্যাংককের সঙ্গে একাধিক সোলো প্রোজেক্ট করেছেন কোরিয়া। সেখানে ল্যাটিন জ্যাজের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে ক্লাসিক্যাল, স্ট্যান্ডার্ড কিংবা সোলো অ্যাকোয়াস্টিক। তবে সবথেকে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফিউশন মিউজিক। জ্যাজ ফিউশনের ক্ষেত্রে এককথায় তাঁকে স্থপতি বলা চলে। তরুণ প্রজন্মকে জ্যাজ এবং ব্লুজের দিকে আকৃষ্ট করতে কোরিয়া রক সঙ্গীতের সঙ্গে মিশ্রণ ঘটান জ্যাজের। ‘রিটার্ন টু ফরএভার’-ই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সঙ্গীতশিল্পী এই ব্যান্ডের অংশ হওয়ায় সেখানে মিশেছে স্প্যানিশ, ব্রাজিলিয়ান, পর্তুগিজ-সহ বিশ্বের একাধিক সংস্কৃতি। সেইসঙ্গে রক জঁর তো ছিলই। 

আরও পড়ুন
শেষ হল কান্ট্রি মিউজিকের একটি অধ্যায়, প্রয়াত কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী চার্লি প্রাইড

তবে সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে একের পর এক কাজ করে যাওয়ার পরেও কোরিয়া ভুলে যাননি প্রথম প্রেম। অ্যাকোয়াস্টিক পিয়ানো। ২০১৩ সালে ব্যাসিস্ট ক্রিশ্চান ম্যাকব্রাইড এবং ড্রামার ব্রায়ান ব্লেডের সঙ্গে জুটি বেঁধে তৈরি করেন অ্যাকোয়াস্টিক-ট্রায়ো। বয়স তখন সত্তরের দোরগোড়া। সেই বয়সে যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল তাঁর ব্যস্ততা। প্রায় সারা বছরই লেগে থাকত একের পর এক আন্তর্জাতিক কনসার্ট, ওয়ার্ল্ড ট্যুর। হয়তো সময় ফুরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত আগেই পেয়েছিলেন তিনি। শুধু তাকে প্রকাশ্যে না এনে চালিয়ে গেছেন একান্ত সঙ্গীতযাপন। দ্রুততার সঙ্গে শেষ করেছেন একের পর এক কাজ। ২০২০ সালে জোড়া অ্যালবাম প্রকাশ হয়তো তারই প্রমাণ।

দীর্ঘ পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের এই সঙ্গীত কেরিয়ারে নজির বিহীন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন চিক কোরিয়া। ঝুলিতে পুরেছেন ২৩টি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড। সুযোগ রয়েছে ‘ট্রিলোজি-২’ অ্যালবামের জন্য গ্র্যামির মঞ্চে মরণোত্তর পুরস্কার প্রাপ্তিরও। জ্যাজ মিউজিশিয়ান হিসাবে যে রেকর্ডের ধারে-কাছেও নেই অন্য কেউ। পেয়েছেন আমেরিকান জ্যাজ মিউজিকের সর্বোচ্চ সম্মান ‘আর্টস জ্যাজ মাস্টার’। গত বছর অ্যালবাম প্রকাশের সময় অ্যাসোসিয়েট প্রেসের একটি সাক্ষাৎকারে কোরিয়া মজার ছলেই বলেছিলেন, ‘একজন অ্যাথলিটের পছন্দের জায়গা হল তাঁর দৌড়ের ট্র্যাক। ঠিক তেমনই পিয়ানোর প্রতিটা চাবির মধ্যে আমি খুঁজে পাই আমার মুক্তির রানওয়ে’। বাস্তবেই সেই ট্র্যাকে বহু বহু কাল আগেই জিতে গিয়েছেন তিনি। স্পর্শ করেছেন অমরত্ব। এবার পালা বিশ্রাম নেওয়ার…

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
স্ট্রিট মিউজিক বাঁচিয়ে রাখার লড়াই, গোলপার্কে ‘মিউজিক্যাল স্যান্ডউইচ’ নিয়ে হাজির নীলাঞ্জন