“ছবি দেখানোর সুযোগের পথ যত দিন খোলা থাকবে, তত দিন আমি পেটের ভাতের জন্য ছবি করে যাব। কালকে বা দশ বছর পরে যদি সিনেমার থেকে ভাল কোন medium বেরোয় আর দশ বছর আমি যদি বেঁচে থাকি, তা হলে সিনেমাকে লাঠি মেরে আমি সেখানে চলে যাব…”
কথাগুলি যিনি বলেছেন, তাঁকে বাংলা তো বটেই ভারতের পরিচালনা জগতের ‘দ্য ট্রায়ো’-এর একজন ধরা হয়। ঋত্বিক ঘটক। নিজের কাজের জায়গায়, ভাবনার জায়গায় এক চুলও ‘ফাঁকি’ দেননি কোনোদিন। কিন্তু সমকাল কি তার মর্যাদা দিয়েছে? তাঁর সিনেমার দিকে চোখ ফেরালে আমরা দেখতে পাই তৎকালীন সমাজের ক্ষয়াটে রূপটা। প্রতি মুহূর্তে ভয়ংকর বাস্তব হয়ে যা উঠে এসেছে। কিন্তু তাঁর ছবি তৈরির আশেপাশের গল্পগুলো? তাঁর নিজের জীবন, ছবিমুক্তির পরের অবস্থা? সেটাও তো তুমুল ঝড়ে আছড়ে পড়েছে বারবার; ক্ষয়ে যাচ্ছিল…
১৯৫২ সাল। পাঁচ বছর হল ভারত স্বাধীনতার মুখ দেখেছে। দেশভাগের ছাপ তখনও তাজা। সেই সময়ই ঋত্বিক বানালেন ‘নাগরিক’। একটি বেকার ছেলের গল্প। যে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করে যায় ক্রমাগত; প্রতিবার হেরে যাওয়ার পর ভাবে - নাহ, আলো আসবে একদিন। কিন্তু আলো আর আসে না। সেই ছেলেটির কথা, প্রেমের কথা, সমাজে ক্রমশ ঘনিয়ে আসা অন্ধকারের কথা উঠে এসেছিল ঋত্বিকের চোখে। কিন্তু শেষ পরিণতি? ব্যবসায়িক ঝামেলার কারণে এটি মুক্তিই পেল না। পরে ১৯৭৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল ছবিটি। তার এক বছর আগেই চলে গিয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক।
পঞ্চাশের দশকেই বিহার সরকারের জন্য তিনটি ডকুমেন্টারিও বানিয়েছিলেন ঋত্বিক। তাঁর একটি ফিলিপিনসে সেরার পুরস্কার পায়। অবশ্য এইসব খবর ছড়িয়ে পড়েনি। শুধু কি সিনেমা? রাজনীতি থেকে নিজেকে আলাদা করে দেখেননি ঋত্বিক ঘটক। সেই বোধ থেকেই তৈরি করেছিলেন একের পর এক নাটক। তাঁরই একটি নাটক ‘দলিল’ সর্বভারতীয় নাট্য সম্মেলনে প্রথম হয়। উল্লেখ্য, এখানে স্বয়ং ঋত্বিক অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু, সেসবের খবর কি কেউ রেখেছিল? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি। আদতে কি এই প্রশ্ন আমাদেরকেও করা নয়?
‘অযান্ত্রিক’ থেকে পরপর তৈরি হতে থাকে অবিশ্বাস্য সব সিনেমা। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’— ভারতীয় সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেই চলেছিলেন তিনি। কিন্তু, পেটের খিদে যে বড় খিদে! পৃথিবীতে টাকা থাকবে না, কাজ থেকে যাবে— সেটা তিনি জানতেনই। কিন্তু সংসারে যে কিছু ঢুকছে না। এতগুলো সিনেমা, একটাও শুরুতে লাভের মুখ দেখল না! পরে অবশ্য পুরো চিত্রটা বদলে যায়। কিন্তু তার আগে হাহাকার ছাড়া কিছু ছিল না। ঋত্বিকের কথায়— “এক ‘মেঘে ঢাকা তারা’ খানিকটা পয়সার মুখ দেখেছিল, সেটা পুরোপুরি চলে গেল ‘কোমল গান্ধার’-এ। ‘কোমল গান্ধার’-এ আমার সব ডুবে গেল।” তাঁর ছবির পেছনে আর কেউ টাকা ঢালে না। প্রযোজকদের কথায়, এর ছবি তো টাকা দেয় না! তিনি তখন একজন ফ্লপ ডিরেক্টর…
ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে যেমন উঠে এসেছে সমাজ, রাজনীতি; তেমনই এসেছে দেশভাগ। আর সেটার আগমনও হয়েছে ব্যাপকভাবে। দেশভাগ যে পরতে পরতে আমাদের সমাজে একটা কালো প্রভাব ফেলে যাচ্ছে, সেটাই তুলে ধরতে চাইতেন ঋত্বিক। নিজেই ‘মেঘে ঢাক তারা’, ‘কোমলগান্ধার’ আর ‘সুবর্ণরেখা’-কে বলেছেন ট্রিলজি। তবে একটি বিশ্বাস তাঁর ছিল বরাবর। তাঁর নিজের সময় তাঁর ছবিকে সমাদর না দিলেও, ভবিষ্যৎ দেবে। তেমন আশাই জোর গলায় রাখতেন তিনি। সেটা বাস্তবও বটে। সমকাল এই দামাল বাঙাল ছেলেকে চিনতে পারেনি। তবুও থেকে যায় প্রশ্ন। ঋত্বিককে কি আমরা আজও পুরোপুরি চিনতে পেরেছি?
ঋণস্বীকার- নিজের পায়ে নিজের পথে/ ঋত্বিককুমার ঘটক