ভিড় করে আসছে একের পর এক দুঃসংবাদ। এই বছর যেন নক্ষত্রপতনের বছর। খেলা, সিনেমা, গান— বাদ নেই কিছুই। প্রয়াত হলেন কান্ট্রি মিউজিকের কিংবদন্তি চার্লি প্রাইড। প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান গায়ক হিসাবে কান্ট্রি মিউজিকের হল অফ ফেম পেয়েছিলেন তিনিই। গতকাল তাঁর ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটেই প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুসংবাদ। করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন কিংবদন্তি সঙ্গীত তারকা। বাড়তে থাকা শ্বাসজনিত জটিলতার কারণে শনিবার মারা যান তিনি। বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
তবে শুরুটা হয়েছিল একটু অন্যভাবেই। বছর ১৪ বছরে প্রথম গিটার কেন চার্লি প্রাইডের। গান কিংবা গিটার বাদন— সবটাই শেখা বলতে, মায়ের কাছেই। ছিল না আলাদা কোনো শিক্ষক। তবে গানকেই যে পরবর্তীকালের সঙ্গী করে নিতে হবে, তেমন কোনো অ্যাম্বিশনই ছিল না তাঁর। একাধিক সাক্ষাৎকারে সে কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। বরং ভালোবাসা ছিল বেসবল। স্বপ্ন ছিল একজন পেশাদার বেসবল খেলোয়াড় হওয়ার।
সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছিলেন প্রাইড। মেমফিস রেড ফক্স, বইস ইয়াংকিস, লুইভিল স্কিপার্স, ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাঞ্জেলস ইত্যাদি একাধিক ক্লাস সি বেসবল দলে খেলেছেন তিনি। বলাই বাহুল্য স্থানীয় ক্রীড়া মহলে বেশ সুনামও ছিল প্রাইডের। তবে অর্থের অভাবেই কাজ নিতে হয়েছিল একটি নির্মাণ সংস্থায়। কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার দরুন অনেকটি সংকীর্ণ হয়ে উঠেছিল উপার্জনের পথ। তাই বাধ্য হয়েই হাতুড়ি তুলে নেওয়া হাতে, হাড় ভাঙা খাটুনির কাজে সঁপে দেওয়া নিজেকে। তারপর যোগ দেওয়া সেনাবাহিনীতে।
তবে খেলার টানেই সেখান থেকে ফিরে এলেন তিনি আবার। ১৯৬০ সালে যোগ দিলেন স্থানীয় ইস্ট হেলেনা ক্লাবে। সেই ক্লাবের ম্যানেজারের কাছে পৌঁছেছিল খবরটা। চার্লি প্রাইড নামের কৃষ্ণাঙ্গ এক খেলোয়াড়ের গানের গলা তুখোড়। সঙ্গে সে গিটার বাজালেও বাকরুদ্ধ হয়ে যায় নাকি সকলে। নিজেও পরীক্ষা করে দেখলেন একদিন তিনি। না, ভুল কিছু নয়। তারপর বেসবল দলে খেলার পাশাপাশি আরও এক দায়িত্ব জুড়ল প্রাইডের কাঁধে। প্রতি ম্যাচ শুরুর আগে ১৫ মিনিট করে তাঁকে গাইতে হবে গান। ম্যানেজার প্রতিশ্রুতি দিলেন তার জন্য আলাদা করে মিলবে ১০ ডলার পারিশ্রমিক।
পেশা হিসাবে সঙ্গীতের হাত ধরা শুরু সেই সেখান থেকেই। সেখান থেকেই শুরু হল আঞ্চলিক নানা অনুষ্ঠান, পার্টি এবং বারে গান গাওয়ার। নাইট হক নামে এক ব্যান্ডেও ডাক এল তাঁর। এত দ্রুত পরিবর্তন নিজেও আশা করেননি প্রাইড। তবে ঐ যে কৃষ্ণাঙ্গ। গায়ের রঙের জন্যই সীমিত ছিল জনপ্রিয়তা।
১৯৬৬ সালে বড়োসড়ো সুযোগ এল তাঁর সামনে। আরসিএ ভিক্টর মিউজিক স্টুডিয়োর কর্ণধার চেট অ্যাটকিনসের কাছে কোনোভাবে পৌঁছেছিল তাঁর একটি নমুন ক্যাসেট। সেইসময় মধ্য গগনে রয়েছেন কান্ট্রি ফোক মিউজিকের সম্রাজ্ঞী জোন বায়েজ। প্রতিদ্বন্দ্বী স্টুডিয়োদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তাই আরসিএ ভিক্টর মিউজিক খুঁজছিল নতুন কোনো মুখ তুলে আনতে। হলও তেমনটাই। প্রথমে একটা সিঙ্গল। তারপর একটা গোটা অ্যালবাম। বদলে গেল যেন সবকিছুই। রেডিও, অন্যান্য রেকর্ডিং স্টুডিও সকলেই যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল চার্লি প্রাইডকে পাওয়ার আশায়।
আরও পড়ুন
নির্বাসন থেকে ফিরেই বিশ্বজয়, প্রয়াত ইতালির কিংবদন্তি ফুটবলার পাওলো রোসি
৭০-এর দশকে আরসিএ মিউজিকের অন্যতম মুখ হয়ে উঠলেন চার্লি প্রাইড। আরসিএ রেকর্ডসে এলভিস প্রেসলির পর বেস্ট সেলিং পারফর্মার হিসাবে উঠে এসেছিলেন তিনিই। ‘ক’-লিগা’, ‘হংকি-টং ব্লুজ’, ‘ইউ উইন এফেন, ‘নেভার বিন সো লাভ’... একের পর এক হিট গান, অ্যালবাম। সব মিলিয়ে বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৭ কোটি রেকর্ড। ১৯৬৬-৮৭ সালের মধ্যে তাঁর লেখা ৫২টি গান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গীত তালিকার প্রথম দশে।
তিন-তিনটি গ্র্যামি পুরস্কার পেয়েছেন চার্লি প্রাইড। ২০১৭ সালে পেয়েছেন আজীবন কৃতিত্বের সম্মাননা। গত ১১ নভেম্বর টেনেসির ন্যাশভিল শহরের কান্ট্রি মিউজিক অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন কৃতিত্ব পুরস্কার পান প্রাইড। সেই অনুষ্ঠানই ছিল তাঁর শেষ পারফর্মেন্স।
কিংবদন্তি তারকের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ গোটা সঙ্গীতমহলই। শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সহ-সঙ্গীতশিল্পীরা। রেবা ম্যাকইনটারি, বিলি রে সাইরাস, ববি বেয়ার, জন প্রাইন শোকপ্রকাশ করেছেন কিংবদন্তির চলে যাওয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের কান্ট্রি মিউজিকের একটা অধ্যায় ফুরিয়ে গেল এভাবেই...
আরও পড়ুন
বিচ্ছেদের ৪৪ বছর পরে ক্ষমাপ্রার্থনা; বব ডিলান ও এক সঙ্গীতময় সম্পর্কের আখ্যান
Powered by Froala Editor