অলিম্পিকে ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক, ডাক পেয়েছিলেন আর্সেনাল ক্লাব থেকেও

নাগাল্যান্ড শুনলেই, সমতলের জনগণ, 'পাহাড়', আর 'সন্ন্যাসী' ছাড়া খুব কিছু বোঝেন না। আর 'নর্থ ইস্ট ভালো ফুটবল খেলে।’ কিন্ত প্রথম অলিম্পিকে অংশ নেওয়া ফুটবল দলের অধিনায়ক যে 'নাগা', কথাটা হজম করতে যে কেমন গায়ে লাগে…

১৯৪৮ সালে অলিম্পিকে গিয়েছিল সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ। গোরাদের বুটজুতোর বিরুদ্ধে খালি পায়ে সমান টক্কর দিয়েছিল গরিব ভারতবর্ষ। ব্রিটিশ মিডিয়া খানিক তাচ্ছিল্যের সুরে প্রশ্ন করেছিল ভারতীয় অধিনায়ককে, “বুট ছাড়া ফুটবল হয়?” উত্তরে মৃদু হেসে দোহারা চেহারার তরুণ বলে উঠেছিলেন, “তোমরা 'বুট-বল' খেলো, আর আমরাই প্রকৃত 'ফুট'-বলার।" বিশ্বকাপের দ্বিতীয় ম্যাচে বাঘের মত খেলেও বিদায় নিতে হয় ভারতীয় দলকে। শেষরক্ষা হয়নি। ভূতপূর্ব তরুণ, পরে কলকাতা থেকে ডাক্তারি পাস করে ফিরে গিয়েছিলেন 'দেশে'। নাগাল্যান্ড-এর সন্তান - তালিমেরেন আও।

'আও' জনজাতির মানুষ, তালিমেরেন। বাবা ছিলেন নাগাল্যান্ডের প্রথম রেভারেন্ড। চেয়েছিলেন ছেলেকে ডাক্তারি পড়াতে। কিন্ত ছোট্ট তালিমেরেন ন্যাকড়ার বলে শট মারতে মারতে ভালোবেসে ফেলে ফুটবল। তবে পড়াশোনায় ফাঁকি পড়েনি কখনও। ইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে পড়তে আসা অসমের বিখ্যাত 'কটন কলেজে'। স্ট্রাইকার হিসেবে তখন সদ্য নাম কিনেছেন বিভিন্ন টুর্নামেন্টে। কটন কলেজের লাগোয়া মাঠে প্র্যাকটিস করতে আসত অসমের সবথেকে বড় ফুটবল ক্লাব 'মহারানা'। খেলোয়াড়দের সঙ্গে বল পেটাতে গিয়ে ক্লাবের নজর কাড়লেন তালিমেরেন।

মহারানায় খেলতে খেলতে বদলে গেলেন তিনি। বদলাল পজিশন। ফুটবলশৈলি। স্ট্রাইকার থেকে হাফ কিংবা ডিফেন্ডার। এখানেই বলা চলে, সবাই ঠাহর করল, তাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা। বরফশীতল স্নায়ু, মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ গড়ে তোলা, প্রয়োজনে হেরো টিমের মনোবল ফিরিয়ে আনা… একজন আদর্শ অধিনায়কের সমস্ত গুণাবলি মিলবে তালিমেরেনের মধ্যে। কিন্ত এত বাহবা পেয়েও তাঁর মাথা ঘুরে যায়নি। ডাক্তারি পড়ার লক্ষ্য অবিচল। একের পর এক দরখাস্ত পাঠানোর পর, শেষে 'কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজে' (অধুনা আর জি কর) জায়গা হল। পাহাড়িয়া নাগাল্যান্ড থেকে 'আও' এলেন 'কলের শহরে'।

গড়ের মাঠ কিন্তু এদিকে লুফে নিল তালিমেরেনকে। বন্ধু শরৎ দাসের সূত্র ধরে মোহনবাগান টেন্টে ঢুকতেই রই-রই পড়ে গেল। তালিমেরেনের নেতৃত্বে মোহনবাগান একের পর এক পার হতে লাগল মাইলস্টোন। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় অলিম্পিক দলের অধিনায়ক হিসেবেও তাঁর জায়গা পাকা। অবশ্য তখন ভারতে ফুটবল খেলাকে কেউ পেশা হিসেবে নেওয়ার কথা ভাবতে পারত না। চাকরি-কলেজ সেরে খেলতে হত ম্যাচ। শোনা যায়, মেধাবী তালিমেরেনকে কেবল অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার জন্য ছুটি মঞ্জুর করেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ।

নাগাল্যান্ডের আদিবাসী ছেলেটি বিদেশের মাটিতে জাতীয় পতাকা তুলেছিল। পেছনে হয়তো বেজেছিল জনগণমন…

অলিম্পিক থেকে ফিরে তালিমেরেন মন দিলেন লেখাপড়ায়। অফার এসেছিল আর্সেনাল ক্লাব থেকে। যাননি। বাবার স্বপ্ন বুকে নিয়ে তিনি সিভিল সার্জেন হয়েই বেরোলেন। যোগ দিলেন কোহিমা হাসপাতালে। পদোন্নতির ফলে সেখানকার মেডিক্যাল ডিরেক্টার হিসেবে অবসর নেন।

সরল-সাধাসিধে মানুষটি। প্রচার এড়িয়ে চলেছেন আজীবন। বাংলা আর অসমের বাইরে তিনি আজও তেমন পরিচিত নন। কারণ তিনি 'আদিবাসী'। 'অসভ্য'। 'পাহাড়ি'। এমন একটা সময় খেলেছেন, যখন নাগা-জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে উত্তাল পাহাড়। বৃটিশবিরোধী 'হেরাকা' আন্দোলন তুঙ্গে। প্রতিস্পর্ধার আগুন বুকে নিয়ে, গোরা শাসকদের মাঠেই জবাব দিয়েছিলেন তালিমেরেন। তাঁর সঙ্গে ছিল ১৯১১-র আই এফ শিল্ড জয়ীদের উত্তরসূরিরা।

Powered by Froala Editor