চ্যালেঞ্জ জিততেই আস্ত ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ লিখে ফেলেছিলেন মাইকেল!

১৮৪৩ সাল। ওল্ড মিশন চার্চের চারিদিকে ভিড়। মানুষের তো বটেই, তবে সাধারণদের নয়; ব্রিটিশ পুলিশের। হাতে অস্ত্র নিয়ে চারিদিকে তীক্ষ্ণ নজর তাঁদের। নিশ্চয়ই গির্জায় বিশেষ কেউ আসবেন! তেমনও কিছু নয়। তাহলে? বিশেষ কেউ না এলেও, বিশেষ একটি ঘটনা ঘটতে চলেছে যে সেখানে। যশোরের দত্ত বাড়ির ছেলে নাকি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করবে! হায় হায় রব পড়ে গেল সব জায়গায়। লাঠি হাতে গির্জায় না আক্রমণ করে বসে সবাই। ছেলের যাতে এমন ‘মতিভ্রম’ না হয়, সেজন্য বাবা রাজনারায়ণ দত্তও কম চেষ্টা করছেন না। কিন্তু মধুসূদন নির্বিকার। তাঁর নিজের দিক থেকে তিনি সঠিক। ধর্ম পরিবর্তনের পর বেশ কয়েকদিন ওই গির্জা থেকেই বেরোননি। তখন অবশ্য তিনি স্রেফ মধুসূদন দত্ত নন; মাইকেল মধুসূদন দত্ত…

তাঁকে বোঝা সবসময়ই একটু মুশকিল। সেই ছোট্ট থেকেই একটু একটু করে ভাষার প্রেমে পড়া। প্রেম— যা সারাজীবন মাইকেল মধুসূদনের সঙ্গী হয়ে থেকেছিল। যেন হয়ে গিয়েছিলেন একটি বিশাল জাহাজ; জীবনের ঝড়-ঝঞ্ঝা, ঢেউ ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল। তবুও নিজের স্বপ্ন ছাড়েননি, জীবন ছাড়েননি। হিন্দু কলেজের ছাত্রটি ইংরেজিতে তুখোড়। কবিতা, সাহিত্য তাঁর মনকে দখল করে নিয়েছে। বড়ো কবি তাঁকে হতেই হবে, বিশ্বের সেরা লেখাটি লিখবেন তিনি— এমন স্বপ্ন নিয়েই অধ্যায়ন করে যাচ্ছেন মধুসূদন। তার জন্য যা করার দরকার তাই করবেন। একসময় সেই কাজটিই করলেন— ধর্ম পরিবর্তন। বিত্তশালী পরিবারের সন্তানটির অনিশ্চিত জীবনের শুরুটাও তখনই। আর কে না জানে, আগুনে না পুড়লে লোহা আরও শক্ত হয় না! 

হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়িত হলেন মাইকেল। গেলেন বিশপস কলেজে; সেখান থেকে সোজা মাদ্রাজ। সামান্য একটা স্কুল মাস্টারের চাকরি, কতই বা মাইনে। এদিকে প্রেমেও পড়লেন, বিয়েও করলেন। সেইসঙ্গে জন্ম নিল ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’। এই বইটিকেই কেন্দ্রবিন্দু ধরতে পারি আমরা? এর আগে সাহিত্য নিয়ে মাইকেলের নজর ছিল শুধুই পাশ্চাত্যের দিকে। ইংরেজিতে লিখবেন, এবং ছড়িয়ে পড়বেন সমস্ত জায়গায়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, ‘ক্যাপটিভ লেডি’র পর আর একটিও ইংরেজি ভাষার বই বের করলেন না তিনি। বদলে এল বাংলার স্রোত। সেই ঢেউয়ে ভেসে গেলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ভেসে গেল বাংলা সাহিত্যও। জন্ম নিল ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর মতো এক মহাগাথার… 

মাইকেল মধুসূদন মানে মেঘনাদবধ কাব্য, এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দ। কুইজ কম্পিটিশনের অবধারিত প্রশ্নগুলির মধ্যে একটি। মাইকেলের আগে এই বিশেষ ছন্দটি কী, সে সম্পর্কে সম্যক ধারণাও ছিল না বাংলা সাহিত্যের। ঈশ্বর গুপ্ত এক-আধবার চেষ্টা করেছিলেন বটে; কিন্তু সফল হননি। আর মাইকেল কিনা সেই দ্বীপেই ঘুরতে লাগলেন! শুরুটা অবশ্য হয়েছিল অনেক আগেই। মাদ্রাজে থাকার সময়ই লিখেছিলেন ‘রিজিয়া’ নাটক। এবং গোটা নাটকটি লেখা হয়েছিল অমিত্রাক্ষর ছন্দেই। কেমন হয়, যদি বাংলাতেও এমনটা করা যায়? 

তখন মাইকেল বাংলায় চলে এসেছেন। বলা ভালো, মাতৃভাষা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছে নিজের কোলে। লিখে ফেলেছেন ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকও। এবং এরপরেই মাইকেল হয়ে উঠলেন বাংলা সাহিত্যের একজন। একটু একটু করে শুরু হচ্ছে ‘মাইকেল যুগ’। এমন সময়ই কথা উঠল অমিত্রাক্ষর ছন্দ নিয়ে। প্রতাপচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গে বসে আছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। পাথুরিয়াঘাটার চেনা মুখ যতীন্দ্রমোহন বললেন, এই অমিত্রাক্ষর ছন্দ বাংলায় কাজই করবে না। এদিকে মাইকেল চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী। তিনি এখানে একা, কিন্তু একাই একশো। এতদিন ধরে চর্চা করছেন এই একটি জিনিস নিয়ে, সেটা ব্যর্থ হতে পারে না। বাংলা নাটকে, সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর না এলে খুবই মুশকিল। শেষমেশ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের দিকে। যে করেই হোক, মাইকেল প্রমাণ করে দেখাবেন অমিত্রাক্ষর ছন্দও মহান। তাকে দিয়েও সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব… 

ভাগ্যিস চ্যালেঞ্জটি জানিয়েছিলেন। তা না হলে ১৮৬১ সালে বাংলা দেখত না ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’। গোটাটাই মাইকেল লিখেছিলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করে। ছন্দের প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে একটা নতুন রূপ দিলেন তিনি। অবাক হলেন যতীন্দ্রমোহন। মাইকেল তখন হাতে জাদু পেয়ে গেছেন। তিনি অন্য জগতে; যেখানে একাই রাজা তিনি। বাংলা আরও অবাক হল, যখন দেখল ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। বাংলা ধন্য ধন্য করে উঠল। কালীপ্রসন্ন সিংহের নেতৃত্বে সংবর্ধনা দেওয়া হল তাঁকে। আজও তো বিমোহিত আমরা! কিন্তু মাইকেল? 

আরও পড়ুন
কলকাতায় এলেন গালিব, তর্কে জড়ালেন অন্যান্য কবিদের সঙ্গেও

লোয়ার সার্কুলার রোডের গোরস্থানে চুপচাপ শুয়ে আছেন তিনি। পাশেই রয়েছেন প্রিয়তমা হেনরিয়েটা। যশোরের দত্ত বাড়ির সন্তান তিনি; অর্থের অভাব ছিল না। কিন্তু নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেওয়ার জীবন তো চাননি মাইকেল! চেয়েছিলেন নিজের শর্তে বাঁচবেন। শেষ জীবনে পকেট শূন্য; হেনরিয়েটা বিনা চিকিৎসায় চলে গেলেন। তিনিও তো কিছুই পেলেন না প্রায়। একা, সর্বস্বান্ত হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে পৃথিবীর আলোটুকু নিয়েছিলেন। মাইকেলের মতো মানুষদের ধারণ করার শক্তি কি আমরাও পেয়েছি? তাঁরা যে কোনো ছকে পড়তে চান না… 

তথ্যসূত্র-
১) ‘দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন’, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘নতুন ছন্দ রচনা সুচতুর কবির’, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত: বাংলার মহাকবি’, রিফাৎ ফারিহা অন্তরা, রোর বাংলা
৪) ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং বাংলা রঙ্গমঞ্চ’, মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, সাহস 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
সংসারে অর্থকষ্ট, জন্মদিনে মেয়েকে কবিতা উপহার দিলেন বুদ্ধদেব বসু

More From Author See More