অগ্নিপরীক্ষা সিনেমায় অনেকগুলো অসামান্য গান ছিল। আমার ঠাকুমা সিনেমাটা দিলেই দেখেছি, ‘জীবননদীর জোয়ার-ভাটায় কত ঢেউ এসে পড়ে’ গানটার জন্যে বসে থাকত। অদ্ভুত দৃশ্য না, বাঙালিবাড়ির একজন ভদ্রমহিলা প্রাক এলইডি বাল্বের সময়ে লাল ডুমের আলোয় হাতের আটা মাখতে মাখতে দু-মিনিট জিরিয়ে নিল গানটায়। পরে আমিও ওঁত পেতে থেকেছি কতদিন সতীনাথের এ-গানটার জন্য।
একটা সময় জুড়ে এই সতীনাথ মুখোপাধ্যায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় শ্যামল মিত্র মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়-রা যে রাজত্ব করে গেলেন, হ্যাঁ রাজত্বই করলেন বাংলা গানে, ইদানীং কেমন যেন বিশ্বাস হয় না। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ছবি মনে পড়লেই খালি মনে হয় একজন নিপাট ভদ্রলোক। যেমনটা মনে হয় জহর গাঙ্গুলির মুখ ভেসে এলে। বলার কথা এই, ঘটনাচক্রে জহর গাঙ্গুলির মৃত্যুদিনও আজই। জহর গাঙ্গুলির মতো ক্রেডিবিলিটি আজ কি একজনেরও আছে! বাংলার এখন যাঁরা সিনিয়র - অরুণ মুখোপাধ্যায়, রজত গাঙ্গুলি - তাঁরা ভালো অভিনেতা হলেও দুঃখের এই, বাংলায় একজনও দেবকীকুমার বসু নেই, যে ভদ্রলোক এঁদের দিয়ে জহর গাঙ্গুলির নবজন্মের মতো একটা চরিত্র করিয়ে নিতে পারেন। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথায় এত কথা বলে ফেলা গেল।
ভাবা যায়, এই সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ই রেডিওর অডিশনে দশবার ফেল করেন, কারণ তাঁর গলা নাকি স্যুট করে না মাইক্রোফোনে। এগারোবারের বার পাশ করলেন। সেটা ১৯৪৮ সাল।
তার অনেক আগে ১৯৪৩ সালে প্রথম রেকর্ড। তবে ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় রেকর্ডের পর বোধহয় সিনারিও বদলে গেল, ‘পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম’ আর ‘এ-জীবনে যেন আর কিছু ভালো লাগে না’ গানদুটোয়।
কীভাবে ইতিহাস হয় কতকিছু! ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে...’ এটা সতীনাথ সুর করেছিলেন পান্নালাল ভট্টাচার্যর জন্যে। উৎপলা সেন বলেছিলেন এটা লতা মঙ্গেশকরকে দিতে। বাকিটা ইতিহাস...
উৎপলা সেনের কথা উঠলই যখন, একটা গানের উল্লেখ করি। নচিকেতা ঘোষের সুরে পবিত্র মিত্রের কথায়, ‘আকাশ ছেয়েছে ঐ কাজল মেঘে সে মেঘ ছড়ায় যে গো আমার মনে, তুমি তার কিছু কী গো জেনেছ!’ এ গানটা শেষ একমাস ঘুর ঘুর করছে।
সতীনাথ মুখোপাধ্যায়কে মহম্মদ রফি বলেছিলেন, আপনি বোম্বে চলে আসুন, এখানে কী করছেন! ভাগ্যিস সতীনাথ যাননি, সুধীন দাশগুপ্তকে গীতা দত্ত বোম্বে নিয়ে গেছিলেন, তাতে বোম্বের লাভ হয়নি, সুধীন দাশগুপ্তেরও নয়।
যাঁরা বড়ো কণ্ঠশিল্পী এবং একই সঙ্গে বড়ো মাপের সুরকার, তাঁদের গলার তলায় সুরকীর্তিগুলো হারিয়ে যায়। যেমনটা প্রবলভাবেই হয়েছে শ্যামল মিত্রের সঙ্গে, মান্না দে-র সঙ্গে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
হেমন্তকে দিয়ে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় দুটো আধুনিক গান গাওয়ালেন, ‘আর কত রহিব শুধু পথ চেয়ে’ আর ‘তোমার আমার কারো মুখে কথা নেই।’ প্রথম গানটা প্রচারিত হলেও, তেমন হয়নি শেষ গানটা।
সুর প্রসঙ্গে একটা ঘটনা আছে, সেবার উৎপলা সেনের কাছে শ্যামল মিত্র আর সতীনাথ গেছেন কার সুর ভালো হয়েছে তদ্বির করতে। সে-বছর দুজনেই দুজনের জন্য সুর করেছেন, উৎপলা সেন শ্যামল মিত্রের সুরের প্রশংসা করে বললেন, তবে এবার সতীনাথের সুর হিট হবে। যার সুর হিট হবে সে কার্টন সিগারেট পাবে অন্যের থেকে। ১৯৫৭ সতীনাথ শ্যামলের সুরে গাইলেন, ‘রাতের আকাশ তারায় রয়েছে ভরে’। শ্যামল সতীনাথের সুরে গাইলেন, ‘তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর হাসি আর গানে ভরে তুলব’। সিগারেটটা সতীনাথই পেয়েছিলেন।
অলোকনাথ দে-র সুর রম্যগীতি গেয়েছিলেন, ‘অনেক তারা ফুটবে যখন আকাশ পারে কস্তুরি মন পাতাল আপন গন্ধে ভরে...’। কী অসম্ভব ভালো গান!
‘রাধিকা বিহনে কাঁদে রাধিকা রমণ’, পুরোদস্তুর রাগাশ্রয়ী বাংলা গান, অথচ কোথাও কোনো দেখানেপনা ছাড়াই এত অসামান্য পরিবেশন সতীনাথের মতো অতি বড়ো শিক্ষিত শিল্পীর পক্ষেই মানায়। যখন দেখি দেড় বছর ক্লাসিক্যাল শিখে একটা গানে অবান্তর কাজকর্ম জুড়ে দেন শিল্পী, তখন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়দের মতো মানুষকে মঙ্গল গ্রহের মনে হয়।
এঁদের আরেকটা গুণ ছিল, এঁরা সবাই সঞ্চারী তৈরিতে মাস্টার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন করে সঞ্চারী এনেছিলেন বাংলা গানে সেটাকেই এঁরা সতীনাথ, মান্না দে শ্যামল মিত্র সহ সবাই একটা অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। এখানে সতীনাথের সেসব গানের উল্লেখ করলে দীর্ঘ তালিকা হবে, তার দরকার নেই। এদিকে হিন্দি গানে কিন্তু সঞ্চারীর প্রয়োগ নেই৷ খুঁজে দেখলে কিছু পাওয়া যাবেই। এ-মূহূর্তে ও পি নাইয়ারের সুর মনে পড়ছে।
আসলে একটা জাতের বাংলা আধুনিক গান একটা ব্যাকবোন। ভারতের অন্য কোনো আঞ্চলিক ভাষায় আধুনিক গানের এই রমরমা ছিল না। আর সেটাই এখন আমাদের কাছে গর্বের বিষয়, আর দুঃখেরও বিষয়।
Powered by Froala Editor