'উম্মা'র বদলে 'উমা', বাঘের গর্জনে বেকায়দায় রবি ঘোষ

শ্যামলা রং, বেঁটেখাটো চেহারা। কিন্তু বেশ শক্তসমর্থ। ছোটো থেকেই শরীরচর্চার পাশাপাশি অভিনয়েরও খুব শখ ছেলেটির। আশুতোষ কলেজে ঢুকেই বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে শুরু হয় নাট্যচর্চা। একইসঙ্গে গতি আসে ব্যায়ামেও। আর এসবই পছন্দ করতেন না ছেলেটির বাবা, জীতেন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদারের। এমন চেহারায় অভিনয়? ‘ওর তো চাকর বাকর ছাড়া কোনো পার্ট জুটবে না।’ এসব সময় নষ্ট। বরং ধরে বেঁধে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিলেই মঙ্গল। এই পুরো কথাই কানে গেল ছেলেটির, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদারের। বাবার এমন কথায় ভেঙে তো পড়েনইনি; উল্টে জেদ চেপে গেল। শরীরের সঙ্গে মনের জোরও যে তাঁর সাংঘাতিক। জীতেন্দ্রনাথ ছেলের ভবিষ্যৎ দেখে যেতে পেরেছিলেন কিনা জানা নেই। যদি দেখতেন, তাহলে বোধহয় প্রতিভা নিয়ে তাঁর মনে সংশয় থাকত না। তখন অবশ্য ছেলে ‘রবীন্দ্রনাথ’ নন; কেবলই ‘রবি’— বাঙালির আদি অকৃত্রিম রবি ঘোষ… 

বরাবরই নিজেকে ফিট রাখতে ভালোবাসতেন। ছোটবেলায় ফুটবল খেলা থেকে শুরু করে একটু বড়ো হয়ে শরীরচর্চা— সব জায়গায় নিষ্ঠা আর পরিশ্রম যেন উপচে পড়ত। এমনকি সার্কাসের দল থেকেও তাঁকে নেওয়ার জন্য হইহই পড়ে যেত। অমন চেহারা যার, সে তো দিব্যি জিমন্যাস্ট হতে পারে! যাননি রবি। আশুতোষ কলেজে ঢুকে আবারও মাথায় চাপল ব্যায়ামের পোকা। ভেবেছিলেন, ওয়েট লিফটিংয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলা জয় করবেন। সেটাও হল না। কেন? নিজের অনেক সাক্ষাৎকার ও ব্যক্তিগত আড্ডায় এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হত রবি ঘোষ’কে। উত্তরও তৈরি থাকত— অভিনয়… 

বাবা তো একটা সময় ত্যাজ্যপুত্র করে দিয়েছিলেন। তাতে যেন আরও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন রবি। এবার নিজের মতো কাজ করতে পারবেন, নিজের মতো জীবন কাটাতে পারবেন। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কফিহাউসে চলত যাতায়াত। চোখের সামনে দেখছেন কমলকুমার মজুমদার, সত্যজিৎ রায়দের। ততদিনে নাটকের জগতেও পা দিয়েছেন তিনি। আরেক অভিনেতা-বন্ধু সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একদিন গিয়েছিলেন ওয়াইএমসিএ-তে। সেখানে তখন মহড়া চলছে। মধ্যমণি উৎপল দত্ত। এদিকে রবি ঘোষ তো পড়লেন মহা বিপদে। না, উৎপল দত্ত বা নাটকের পরিবেশ দেখে নয়; অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলার ভয়। মধ্যবিত্ত বাঙালি ছেলে, বাংলাই আশা-ভরসা। এভাবে চোস্ত ইংরেজিতে তো কথা বলেনইনি। রক্ষাকর্তা হয়ে এলেন স্বয়ং উৎপল দত্ত, সঙ্গে ‘সর্বজয়া’ করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইংরেজিতে কথা বলতে হয়নি আর। উৎপল দত্তের নাটক থেকেই জীবনের অন্য দিক খুলে গেল তাঁর। পরবর্তীতে একসঙ্গে সিনেমাতেও নামবেন তাঁরা… 

উৎপল দত্তের নাটক দেখেই ‘অভিযান’-এর জন্য রবি ঘোষকে নির্বাচিত করেন সত্যজিৎ রায়। আর এই তিনজনের কথা বললে অবধারিতভাবে এসে পড়ে ‘হীরক রাজার দেশে’। বাঙালি তাঁর চিরদিনের ‘বাঘা বাইন’-কে আগের সিনেমাতেই পেয়ে গিয়েছিল। এই সিনেমা যেন সবদিক থেকে ছাপিয়ে গেল। ‘হীরক রাজার দেশে’র শুটিংয়ের জন্য সবাই গেছেন মাদ্রাজ। চলছে ‘পায়ে পড়ি বাঘ মামা’ গানটির টেক। হিরে নেওয়ার জন্য ঘরে ঢুকেই থমকে গেল গুপী আর বাঘা। ভেতরে পাহারায় যে ‘তিনি’ রয়েছেন! মস্ত বড়ো এক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার! গানের জোরে তাকেও শান্ত করে দেন ‘গুপী’ তপেন চট্টোপাধ্যায়। 

আর সেই কাজ করতে গিয়েই বিপদ। শুটিং চলাকালীন বাঘটির মাদ্রাজি ট্রেনার বলে দিয়েছিলেন, ভিজে তোয়ালে বুলিয়ে ‘উম্মা’ বলতে হবে। সেই ‘আদর’-এর দায়িত্ব নিয়েছিলেন রবি ঘোষ। দিব্যি হাত বোলাচ্ছিলেন; হঠাৎ একসময় ‘উম্মা’ বলতে গিয়ে ‘উমা’ বলে ফেলেন। ব্যস, আর যায় কোথায়! মাদ্রাজি বাঘের ‘জাত্যাভিমানে’ ঘা লাগে। রবি ঘোষের সামনে গর্জন করতে করতে উঠে পড়ল সেই দশাসই চেহারা। এক মুহূর্ত যেন চোখে অন্ধকার দেখলেন তিনি। ভাগ্যিস ট্রেনার আশেপাশেই ছিলেন। কোনমতে বাঘটিকে সামলে নিলেন তিনি। ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলেন ‘বাঘা’… 

সত্যিই আদ্যোপান্ত বাঙালি ছিলেন তিনি। তা না হলে ‘ধনঞ্জয়’ কি অমন জীবন্ত হতে পারত? একটা সময় স্বয়ং পরিচালক তপন সিনহাও বলেছিলেন, ‘গল্প হলেও সত্যি’ লিখেছিলেন শুধুমাত্র রবিকে দেখেই। অমন দাপুটে অভিনয়, অমন কমিক সেন্স, হিউমর আর কার মধ্যে আছে? হিউমরেরও যে নানা দিক আছে, নানাভাবে সেই অভিনয় সামনে আনা যায় সেটা বিশ্বাস করতেন রবি ঘোষ। এমনই তাঁর বাঙালি সত্তা, মুম্বইতে কাজের অফার পেয়েও গেলেন না। শর্মিলা ঠাকুর থেকে জয়া ভাদুড়ি— প্রত্যেকেরই ‘গার্জিয়ান’ তিনি। তখন প্রথম স্ত্রী অনুভা গুপ্ত মারা গেছেন। রবি ঘোষ বিয়ে করলেন বৈশাখীদেবীকে। দুজনে মিলে মুম্বই এসেছেন। কোথা থেকে যেন খবর পেয়ে গেলেন জয়া ভাদুড়ি। ততদিনে অবশ্য ‘বচ্চন’ হয়ে গেছেন। হোটেল থেকে ‘রবিদা’-কে নিয়ে এলেন নিজের বাড়ি। আড্ডা মারতে মারতে কখন যে ঘড়ির কাঁটা রাত একটা ছুঁয়েছে, খেয়ালই নেই কারোর। এবার কী করে ফিরবেন? গাড়িও তো নেই। এগিয়ে এলেন অমিতাভ বচ্চন। তখন তিনি বেশ অসুস্থ; ‘কুলি’র শুটিংয়ের সময় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর রবিদা-কে কি এভাবে ছাড়া যায়? সঙ্গে যে স্ত্রীও রয়েছেন। অত রাতে, ওই শরীর নিয়ে নিজে ড্রাইভ করে নিয়ে গিয়েছিলেন সিনিয়র বচ্চন … 

আরও পড়ুন
প্রথম কোনো ভারতীয় সিরিজ হিসাবে এমি পুরস্কার জয় ‘দিল্লি ক্রাইম’-এর

শেষলগ্নে মনে আসছে আরেকজনের কথা। সদ্যপ্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। দুজনে একসঙ্গে সিনেমায় নেমেছিলেন সত্যজিতের হাত ধরেই। তখন ষাটের দশক। ‘অভিযান’-এর জন্য সত্যজিতের বাড়িতে হাজির হয়েছেন রবি ঘোষ এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে শুরু হল দুজনের মধ্যে গল্প। এভাবে না হেঁটে এক জায়গায় বসেও তো গল্প করা যায়। রাজি হলেন রবি। চলে এলেন চাংওয়াতে। বিয়ার সহযোগে জমে উঠল আড্ডা। প্রথম আলাপেই বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন দুজনে। বহুদিন পর আবারও একসঙ্গে আড্ডায় মাতবেন উদয়ন পণ্ডিত এবং বাঘা বাইন। আফসোস, আমরা আর সেই মুহূর্ত দেখতে পাবো না… 

তথ্যঋণ-
১) ‘অগ্রপথিকেরা’/ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
২) ‘চকোলেটের লোভ দেখিয়ে রাজি করিয়েছিলেন জয়া ভাদুড়িকে’, দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘গল্প হলেও সত্যি! কেরানীর চাকরি ছেড়ে অভিনয়কেই বেছে নিয়েছিলেন রবি ঘোষ’, নিউজ ইন্ডিয়া প্রেস বাংলা 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
পাহাড়ি রাস্তায় দৌড়ে হাঁপানির অভিনয়, অপুর চরিত্র তাঁকে ভুগিয়েছে শ্বাসকষ্টেও

More From Author See More