সালটা ১৯৬০। সময়টা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকা আর রাশিয়ার ঠান্ডা লড়াই তখন একেবারে শীর্ষে। একদিকে সাম্যের মন্ত্র নিয়ে সারা পৃথিবীর সামনে নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করছে রাশিয়া। আর আমেরিকা তখন অর্থনীতিতে ক্রমশ এগিয়ে গেলেও জাতিহিংসা, লিঙ্গহিংসায় জর্জরিত। সারা পৃথিবী যেন একসুরে বলছে, আমেরিকা আর যাই পারুক, মানুষকে তার প্রকৃত সম্মান দিতে পারে না। ঠিক এই সময় অনুষ্ঠিত হল রোম অলিম্পিক। আর সেটাই সারা পৃথিবীর সামনে আমেরিকার ভাবমূর্তি বদলে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ।
অলিম্পিকের ব্যাটন নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছেন পৃথিবীর সমস্ত দেশের প্রতিনিধিরা। আছেন আমেরিকার অলিম্পিক দলের প্রধানও। কিন্তু একি! যে মানুষটি আমেরিকার জার্সি গায়ে দিয়ে ব্যাটন হাতে ছুটছেন, তিনি কি আদৌ আমেরিকার? কই, তাঁর গায়ের রং তো সাদা নয়। তাঁর শরীরে আভিজাত্যের লাবণ্য নেই। বরং তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের মতোই এক লড়াকু দৃষ্টি চোখেমুখে। আর কালো চামড়া দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তেলঘাম। ২৫ বছরের যুবক রাফের জনসন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে জানালেন, তিনিই আমেরিকার অলিম্পিক দলের প্রধান। আফ্রিকান-আমেরিকান নন, তিনি আমেরিকান। যে আমেরিকা সমস্ত মানুষের সমানাধিকারের কথা বলে, যে আমেরিকা একসময় ক্রীতদাস হিসাবে নিয়ে আসা আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মানুষদের অধিকারের কথা বলে, তিনি সেই আমেরিকার প্রতিনিধি।
সেবারের ডেকাথলনের প্রতিযোগিতা সহজ ছিল না। একদিকে তাইওয়ানের প্রবল পরাক্রমী অ্যাথেলিট সিকে ইয়াং, আর অন্যদিকে রাফের জনসন। বাকিরা পিছিয়ে পড়েছেন অনেক আগেই। শুধু প্রথম ৯টি ইভেন্টের পরেও রাফের এবং ইয়াং-এর স্কোর প্রায় সমান সমান। বাকি শুধু একটি ইভেন্ট। ১৫০০ মিটারের দৌড়। আর এখানেই ইয়াং-কে টপকে স্বর্ণপদক ছিনিয়ে নিলেন রাফের। ব্যবধান ছিল যদিও মাত্র ১.২ সেকেন্ডের। কিন্তু ইয়াং তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, রাফেরের দৃষ্টি দেখেই তিনি বুঝেছিলেন প্রাণ থাকতে তাঁকে জিততে দেবেন না রাফের।
১৯৩৪ সালে টেক্সাসের হিলসবরো অঞ্চলে জন্ম রাফের জনসনের। ছোটোবেলা থেকে বেড়ে ওঠার লড়াইটা সহজ ছিল না। পদে পদে দারিদ্র্য আর অনাহারের সঙ্গে লড়াই। তার মধ্যে নিগ্রো বলে অপমান তো আছেই। রাফের জানতেন, প্রতিটা হিসাব বুঝে নিতে হবে। আর এই পৃথিবীতে যার জোর আছে, সেই নিজের অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারে। অতএব শুরু হল শরীরচর্চা। এক বন্ধুর থেকে ভর্তির মূল্য ধার করে ঢুকে পড়লেন ইউসিএলএ-তে। আর তারপর নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ১৯৫৬ সালে অলিম্পিকে রৌপ্যপদক, আর ১৯৬০ সালে সোনা। না, এরপর আর খেলার ময়দানে দেখা যায়নি তাঁকে। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন সিনেমার জগতে।
আরও পড়ুন
যুবসমাজকে সম্প্রীতি ও সাম্যের পাঠ দিয়ে দেশের সেরা সমাজকর্মী আশরাফ প্যাটেল
১৯৬০ সালের অলিম্পিকের পরেই রাফেরের আলাপ হয় প্রেসিডেন্ট কেনেডির সঙ্গে। তারপর কখন যে পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন, নিজেও বুঝতে পারেননি। ১৯৬৮ সালে কেনেডির মৃত্যুর পর তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর অসহায় মুখ দেখে ফিরে যেতে পারলেন না। আর সেখান থেকেই শুরু হল নতুন লড়াই। সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে গড়ে তোলার লড়াই। পাশাপাশি চলতে থাকল অভিনয়। ‘দ্য সিনস অফ রাচেল কেড’ দিয়ে শুরু। তারপর একে একে টারজানের প্রায় সমস্ত সিনেমায় দেখা গিয়েছে তাঁকে। জেমস বন্ড সিনেমা ‘দ্য লাইসেন্স টু কিল’ এবং ‘থিংক বিগ’ দিয়ে সেই যাত্রাও শেষ হল মাত্র ১১টি সিনেমায়।
২ ডিসেম্বর ৮৬ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন রাফের জনসন। যাওয়ার আগে দেখে গেলেন ট্রাম্পকে হারিয়ে হোয়াইট হাউসে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জো বাইডেনের আগমন। দেখে গেলেন, ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের ঢেউ আমেরিকা ছাড়িয়ে ইউরোপ সহ পৃথিবীর সমস্ত দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। হয়তো এই দিনগুলো দেখার জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
করোনার বিরুদ্ধে চিকিৎসকের ভূমিকায় অস্ট্রেলিয়ার স্বর্ণপদকজয়ী অ্যাথলিট
Powered by Froala Editor