গবেষণার ‘সঙ্গী’ ছিলেন স্টিফেন হকিংও; প্রয়াত কিংবদন্তি জোর্তিবিজ্ঞানী শশীকুমার চিত্রে

১৯৬৭ সাল। তিনি তখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ই পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করার পৃথিবীর অন্যতম পীঠস্থান। প্রযুক্তিগত দিকে ভারতের থেকে বহুগুণ এগিয়ে কেমব্রিজ। সেইসঙ্গে প্রভূত সুযোগ-সুবিধা। অন্যদিকে তখন পরাধীনতার গ্লানি মুছে নতুন করে বিজ্ঞানের ‘নবজাগরণ’-এর যজ্ঞ শুরু করেছে ভারত। যার দ্বীপ জ্বেলে গেছেন স্বয়ং হোমি ভাবা। তাকে তো নিভে যেতে দেওয়া যায় না। সবকিছুকে পিছনে ফেলেই তাই তিনি চলে এসেছিলেন ভারতে। শুরু করেছিলেন অধ্যাপনা।

জোতির্বিজ্ঞানী শশীকুমার মধুসূদন চিত্রে। সৌরবিজ্ঞানে তাঁর গবেষণা ভারতকে পৌঁছে দিয়েছিল বিশ্বদরবারে। বার্ধক্যজনিত কারণে দীর্ঘদিন থেকেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। কিছুদিন আগে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন আম্বানি হাসপাতালে। গতকাল সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তি বিজ্ঞানী। বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।

১৯৩৬ সালে মুম্বাইতে জন্ম শশীকুমার চিত্রের। বেড়ে ওঠাও বাণিজ্যনগরীতে। বান্দ্রায় স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার পর মুম্বাইয়ের এলফিনস্টোন কলেজে ভর্তি হন গণিত নিয়ে। সেখান থেকেই সম্পূর্ণ করেন স্নাতকতা। তবে গণিত নিয়ে পড়তে গিয়েই পদার্থবিদ্যার প্রতি তৈরি হয়ে যায় এক গভীর ভালোবাসা। নেপথ্যে ছিলেন কলেজেরই গণিত অধ্যাপক পি আর মাসানি।

১৯৫৬ সালে স্নাতকতা সম্পূর্ণ করার পর ‘ডিউক অফ এডিনবার্গ’ বৃত্তি পেয়ে তিনি পড়াশোনা করতে যান কেমব্রিজে। যুক্তরাজ্যের পিটারহাউস কলেজে গণিতের ‘ট্রিপো’ বিভাগ এবং সৌর-কলঙ্কের ওপর দ্বিতীয় স্নাতকতা সম্পূর্ণ করেন। তারপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। সেসময় তাঁর সহপাঠী ছিলেন ২০২০-র নোবেলজয়ী পদার্থবিদ রজার পেনরোজ। তবে সবাইকে চমকে দিয়েই ‘গালবেনকিয়ান স্টুডেন্ট ফেলোশিপ’ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন সেদিনের সেই ভারতীয় তরুণ।

১৯৬৩ সালে চার্চিল কলেজ থেকে ব্যবহারিক গণিত এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি সম্পূর্ণ করেন শশীকুমার চিত্রে। গবেষণার বিষয় ছিল সৌরকলঙ্ক। আর সহকর্মী হিসাবে পাশে ছিলেন কিংবদন্তি স্টিফেন হকিং। দুই কিংবদন্তির মধ্যে সেসময় গড়ে উঠেছিল এক অদ্ভুত ঘনিষ্ঠতা। এমনকি ভারতীয় ‘বন্ধু’কে ক্রোকেট খেলতে শিখিয়েছিলেন হকিং।

১৯৬৩ সালে চিত্রে লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। তবে তাঁর গবেষণায় বড়ো অঙ্কের অনুদান দিতে অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত তহবিলজনিত সমস্যার কারণেই ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (ক্যালটেক)-এ যোগদান করেন চিত্রে। সেখানে পারমাণবিক পদার্থবিদ উইলিয়াম ফাওলার এবং কিপ থোর্নের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। তাঁরাই নিউট্রন স্টারের ব্যাপারে আগ্রহী গড়ে তোলেন তাঁরা।

আরও পড়ুন
অঙ্কে ভয় পেতেন ছোটোবেলায়, নোবেল জিতে সেই অতীতকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেন রজার পেনরোজ?

তবে সেখানেও বেশিদিন টেকা হল না। দেশের ‘বিজ্ঞান-বিপ্লব’-এর কথা চিন্তা করেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৯৬৭ সালে ভারতে পাড়ি দিলেন চিত্রে। অধ্যাপক হিসাবে দায়িত্ব নিলেন মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট-এ (টিআইএফআর)। ২০০১ সাল পর্যন্ত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নিয়মিত ক্লাস নিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি সামলেছেন হোমি ভাবা ফেলোশিপ কাউন্সিলের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরের দায়িত্বও। তাছাড়া অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইট অফ ইন্ডিয়ার সভাপতিত্বও করেছেন তিনি দীর্ঘ সময়।

তাঁর গবেষণার মূল বিষয়ই ছিল সূর্য-কেন্দ্রিক। সূর্যের চৌম্বকীয় প্রভাব চক্র, সৌর ডায়নামো তত্ত্ব, সৌর বায়ুমণ্ডলে আধানবিহীন কণার ভূমিকার বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেন চিত্রে। সেইসঙ্গে সৌরকলঙ্কে বিবিধ বর্ণের উপস্থিতি এবং মেরুকরণ নিয়েও কাজ করেছেন চিত্রে। মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ের কলিনা বেসিক সায়েন্স এক্সিল্যান্সের জন্য পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রের অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার পিছনে মূল অবদান ছিল তাঁরই।

তবে শুধুমাত্র গবেষণাগারে বসে তত্ত্বের চর্চাই বিজ্ঞানের বিপ্লব আনবে ভারতে, এমনটা বিশ্বাস করতেন না তিনি। চাইতেন একদম প্রাথমিক স্তর থেকেই ভারতীয় শিক্ষার্থীরা পরিচিত হোক পদার্থবিদ্যার সঙ্গে। সেই লক্ষ্য নিয়েই বিজ্ঞানের একটি নেটওয়ার্ক তৈরির কাজে নেমেছিলেন কিংবদন্তি বিজ্ঞানী। কলেজ তো বটেই, বরং সরকারি স্কুলগুলিতেও বিভিন্ন সময় বক্তৃতা দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না চিত্রে। তরুণ প্রজন্মকে বিজ্ঞানমুখী করে তুলতেই প্রায়ই তিনি ছুটে বেড়াতেন দক্ষিণের বিভিন্ন শহরে।

আরও পড়ুন
শুধুই পদার্থবিদ্যা নয়, বাংলার নদী-নালা নিয়েও দীর্ঘ গবেষণা করেছিলেন মেঘনাদ সাহা

২০১২ সালে বিজ্ঞানে তাঁর অনস্বীকার্য অবদানের জন্য পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে ভারত সরকার। এছাড়াও ভি বি মেমোরিয়াল মেডেল এবং এম পি বিরলা সম্মাননা পেয়েছেন চিত্রে। সম্মাননা দিয়েছে রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটি, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন, ওয়ার্ল্ড একাডেমি অফ সায়েন্সেসের মতো সম্মানজনক বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান। এক্সট্রাটারেস্ট্রিয়াল ফিজিক্সের জন্য ফেলোশিপ প্রদান করেছে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট।

শেষ বয়সেও তিনি মুম্বাইয়ের নেহেরু বিজ্ঞান কেন্দ্রের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। তবে সায় দিত না শরীর। কিন্তু তাঁর শিশুসুলভ মানসিকতা সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ভেঙেই হাজির হতে চাইত এই সমস্ত সভায়। অনুপস্থিত থাকলেও নিশ্চুপেই বিজ্ঞান চর্চার অভিভাবকত্ব করে গেছেন তিনি। সাধ্য মতো পরামর্শ দিয়েছেন সকলক্ষেত্রেই। কিংবদন্তি এই বিজ্ঞানীর চলে যাওয়ায় ফাঁকা হয়ে গেল সেই জায়গাটাই। যে ক্ষতি অপূরণীয়...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের বাতিল যন্ত্রাংশ দিয়ে গবেষণা, বাঙালি পেয়েছিল পদার্থবিদ্যায় প্রথম মহিলা ডক্টরেটকে

More From Author See More