গিন্সবার্গের কবিতা ছাপিয়ে খেটেছেন জেলও; প্রয়াত মার্কিন কবি ও প্রকাশক লরেন্স ফারলিংহেটি

১৯৫৩ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল কিংবদন্তি বইয়ের দোকান ‘দ্যা সিটি লাইটস’-এর। তারপর নীরবেই বিট আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছিল এই প্রতিষ্ঠান। আর এই প্রতিষ্ঠানেরই একক উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। তুলে এনেছিলেন উত্তরাধুনিক কবিতা, গল্প, উপন্যাস। দাঁড়াবার জায়গা করে দিয়েছিলেন জ্যাক কেরুয়াক, অ্যালেন গিন্সবার্গ এবং উইলিয়াম এস বুরোসের মতো তৎকালীন বিট আন্দোলনের কবি, প্রাবন্ধিকদের। চলে গেলেন আমেরিকান শীর্ষস্থানীয় ‘বিট’ কবি ও প্রকাশক লরেন্স ফেরলংহেটি। শেষ হল আমেরিকার দীর্ঘ সাহিত্য ইতিহাসের একটি অধ্যায়।

বার্ধ্যজনিত সমস্যা তো ছিলই, পাশাপাশি বেশ কিছুদিন ধরেই ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে ভুগছিলেন তিনি। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও মাথা চারা দিচ্ছিল। গত সপ্তাহেই কোভিড ভ্যাকসিন নেন কবি লরেন্স। তবে শেষরক্ষা হল না। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই চিরঘুমে তলিয়ে গেলেন তিনি। বয়স হয়েছিল ১০১ বছর। দ্য সিটি লাইট কর্তৃপক্ষের তরফেই জানানো হয়, গত সোমবার মৃত্যু হয়েছে কিংবদন্তি কবির।

১৯১৯ সালের ১৪ মার্চ লরেন্সের জন্ম নিউ ইয়র্কের ইয়োংকার শহরে। তবে জন্মের আগেই হৃদরোগে মারা গিয়েছিলেন তাঁর বাবা। শোক সহ্য করতে পারেননি তাঁর মা-ও। মানসিক হাসপাতালে দীর্ঘদিন থাকার পর সেখানেই মারা যান তিনি। লরেন্সের বড়ো হয়ে ওঠা পুরোপুরি মাসির কাছেই। নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪১ সালে সাংবাদিকতায় স্নাতকতা সম্পূর্ণ করেন লরেন্স। ‘দ্য ডেলি টার হিল’ পত্রিকায় কাজ নেন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসাবে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত লেখালিখিও চলত তখন থেকেই। বছর কয়েকের মধ্যেই ‘ক্যারোলিনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর একগুচ্ছ ছোটোগল্প। ‘প্রথাগত’ সাহিত্যের জগতে ঢুকে পড়া হয়তো তখনই।

খুব বেশিদিন সাংবাদিকতায় টিকে থাকতে পারেননি লরেন্স। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অংশ নেন মার্কিন সেনাবাহিনীতে। তবে যুদ্ধের সেই বীভৎসতাই তাঁকে সরিয়ে আনে সেখান থেকে। যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে আবার শুরু করেন পড়াশোনা। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৭ সালে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করেন ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে। সেসময় জন রাস্কিং এবং ব্রিটিশ চিত্রকার জোসেফ উহিলিয়াম টার্নারের ওপর দুটি গুরুত্বপূর্ণ থিসিসও প্রকাশ করেছিলেন লরেন্স। এরপর প্যারিসে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়তে যান তিনি।

আরও পড়ুন
বন্ধুর অহংকার ভাঙাতেই প্রথম কবিতা লেখেন শিবনাথ শাস্ত্রী

সিটি লাইটস-এ চাঁদের হাট

 

১৯৫১ সালে ফ্রান্স থেকে ফিরে তাঁর নতুন ঠিকানা হয়ে ওঠে সান ফ্রান্সিসকো। সেখানেই ১৯৫৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘দ্য সিটি লাইটস’। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বপ্রথম অল-পেপারব্যাক বইয়ের দোকান। লক্ষ্য ছিল আমেরিকান সাহিত্যের ‘গণতন্ত্রীকরণ’। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যেন ব্যয়বহুলতার কারণে না পিছিয়ে যায় সাহিত্য পড়া থেকে, তাই নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন লরেন্স। বন্দোবস্ত করেছিলেন বৈচিত্রময় বিভিন্ন স্বাদের গ্রন্থ সস্তায় ছাপানোরও।

আরও পড়ুন
লাইব্রেরি থেকে উদ্ধার কবি অ্যান্ড্রু প্যাটারসনের ১২০ বছরের পুরনো চকলেট, জড়িয়ে যুদ্ধের ইতিহাসও

খুব বেশিদিন সময় লাগেনি সিটিলাইটের। প্রগতিশীল রাজনীতি এবং বোহেমিয়ানিজমের আঁতুড়ঘর হয়ে ওঠে এই প্রতিষ্ঠান। জায়গা করে দেয় বিট আন্দোলনের কবি, সাহিত্যিক, থিয়েটার এবং অন্যান্য শিল্পীদের। লরেন্স নিজেও তাঁদের সঙ্গে কোমর বেঁধেই নেমে পড়েন সাহিত্যসৃষ্টিতে। বাক্‌স্বাধীনতার অধিকারের ক্ষেত্রেও একাধিকবার সরব হয়েছিলেন তিনি। আর সিটিলাইটের হাত ধরেই মূলধারার রক্ষণশীল মনোভাব, অর্থনৈতিক বস্তুবাদ এবং যুদ্ধকে প্রত্যাখ্যান করে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল আমেরিকায়। যার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল সান ফ্রান্সিসকো।

সিটিলাইটের প্রকাশক এবং এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জুড়ে থাকা অধিকাংশ সাহিত্যিকই বিশ্বাসী ছিলেন মানবিক শান্তি, যৌন মুক্তি এবং সাইকিডেলিক ড্রাগে। যে কারণে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সহজেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। আর এভাবেই সমাজের ‘দুরবস্থা’-র কথা তাঁরা তুলে ধরতেন সাধারণের মধ্যে।

আরও পড়ুন
পূর্ণতা পায়নি প্রেম, পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে খোদিত রইল এক কবির বিরহব্যথা

লরেন্স ও গিন্সবার্গ

 

তবে খুব কিছু সহজ ছিল না কাজটা। গিন্সবার্গের ঐতিহাসিক কবিতা ‘হাউল’ প্রকাশ করেছিলেন লরেন্সই। যা আমেরিকান সাহিত্যের সর্বকালীন অন্যতম সেরা কাজ হিসাবেই বিবেচনা করা হয় আজকের দিনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু এই কবিতার জন্যই জেলে যেতে হয়েছিল লরেন্সকে। কেননা সমকামিতা এবং ড্রাগের কথা বর্ণিত হয়েছিল এই কবিতায়। আদালতে শাস্তি পাওয়ার পরেও নির্বিকার থাকেন লরেন্স। এতে যে তাঁর বিন্দুমাত্র ভুল হয়েছে, সে কথা মানতে রাজি ছিলেন না তিনি। বছর তিনেক পর ‘অপরাধ’ জেনেও তিনি আবার প্রকাশ রেন বইটি। সেদিন ‘হাউল’ প্রকাশ না পেলে হয়তো আজ বিশ্বজুড়ে এই লেখালিখির মানচিত্র খানিক অন্যরকমই হত।

১৯৫৫ সালে প্রকাশ পায় লরেন্সের প্রথম কবিতার বই ‘রুটিন’। ‘পিকচারস অফ দ্য গন ওয়ার্ল্ড’, ‘আ কোনি আইল্যান্ড অফ দ্য মাইন্ড’, ‘হাউ টু পেন্ট সানলাইট’, ‘পোয়েট্রি অ্যাস ইনসার্জেন্ট আর্ট’-এর মতো কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ মিলিয়ে ৩০টিরও বেশি বই লিখেছেন লরেন্স। সেইসঙ্গে চালিয়ে গেছেন থিয়েটার এবং চিত্রশিল্পের কাজও।

১৯৮৩ সালে ‘এডুকেশন রিটা’ চলচ্চিত্রে দেখা যায় তাঁকে। যা ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিল ব্রিটেনে। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে বিট আন্দোলনের একটি তথ্যচিত্রেও দেখা গেছে তাঁকে। অবশ্য সেই তথ্যচিত্রের সাক্ষাৎকারে নিজেকে ‘বিট কবি’ বলে মানতে চাননি তিনি। বরং বিট আন্দোলনের একজন কর্মী হিসাবেই তিনি চিহ্নিত করেন নিজেকে।

বিট আন্দোলনের কবি তিনি ছিলেন কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে হয়তো সান ফ্রান্সিসকো দেখতে পেত না এই নবজাগরণের লড়াই। প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার বুনিয়াদ গড়ে তুলতে আরও সময় লেগে যেত যুক্তরাষ্ট্রের। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আজকের সমাজের, যাপনের কারিগর তিনিই। তিনিই ‘গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল’ এই উত্তরাধুনিকতার… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More