তিরিশের দশকের শুরুর সময়। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে হাজির হলেন এক যুবক। আসামের গৌরীপুর রাজবাড়ির বড়ো রাজকুমার হয়েও, সব ছেড়েছুঁড়ে কলকাতায় এসেছে সিনেমার টানে। সেই সুবাদেই হাতে এসে পড়ল শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’। যদি এটাকে সিনেমায় আনা যায়? সোজা চলে গেলেন লেখকের বাড়িতে। শরৎচন্দ্র তো অবাক! এর আগে ‘দেবদাস’কে সিনেমার বিষয় হিসেবে কেউ ভাবেননি। শরৎচন্দ্র নিজেও খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না। কী আছে দেবদাসে, যে বড়োপর্দায় আসবে? কিন্তু প্রমথেশ বড়ুয়া আশাবাদী। যে করেই হোক, লেখকের কাছ থেকে স্বত্ব নিয়ে ‘দেবদাস’ করবেনই তিনি…
শরীরে ছিল রাজরক্ত। গৌরীপুরের বিশাল এস্টেটের দায়িত্বে ছিলেন বড়ুয়া পরিবার। আর সেই পরিবারেই জন্ম নিলেন প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া। তিনি বাংলা সিনেমার সুপারস্টার, চিরাচরিত রাস্তার মোড় ঘোরানো একজন কিংবদন্তি। কিন্তু এসব তো এসেছে অনেক পরে। প্রমথেশ বড়ুয়ার জীবনের দিকে তাকালেও মনে হবে এক জলজ্যান্ত চিত্রনাট্য। অদ্ভুতভাবে, দেবদাসের মতোই অদ্ভুত সমাপতন তাঁর। অজান্তে নিজের জীবন আর পর্দা— দুই জায়গাতেই ‘দেবদাস’ হয়ে গিয়েছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া।
ছোটবেলাটা অবশ্য এসব থেকে দূরে ছিল। এস্টেটের বড়ো রাজকুমার বলে কথা! শৌখিনতা, বিত্তের সঙ্গে যেন নিত্যদিনের ওঠাবসা। সেইসঙ্গে ছিল আরও একটি জিনিস— শিকার। রাজা-রাজড়া হোক বা জমিদার, সবার ক্ষেত্রে এই জিনিসটি ছিল সাধারণ একটি ব্যাপার। বিশেষ করে, গৌরীপুর রাজ পরিবারের প্রায় সব ছেলেরাই শিকারে অংশ নিত। ধীরে ধীরে সেই চক্রে এসে পড়লেন প্রমথেশ। শিকার যে তাঁর খুব একটা পছন্দ ছিল তা নয়। কিন্তু তাও যথেষ্ট পটু হাত ছিল তাঁর। মাত্র তেরো বছরের কিশোর প্রমথেশ আস্ত বাঘ শিকার করেন, তাও একার চেষ্টায়। আসামের ঘন জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে কত যে বাঘ, চিতা, গণ্ডারের শিকার করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই।
শিকারে যখনই যেতেন, তখন সঙ্গে থাকত আঁকার জিনিসপত্র। ফাঁকা সময় বসে পড়তেন ইজেল আর ক্যানভাস নিয়ে। আর বাঘ-গণ্ডার শিকার করতেন যিনি, তিনিই কিনা ভয় পেতেন সামান্য আরশোলায়! এই নিয়ে নানা কাহিনিও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ঠিক দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদারের স্বভাব ছিল না প্রমথেশ বড়ুয়ার। মানুষের দুঃখ তাঁকে ভাবাত। বাবা চেয়েছিলেন, পরিবারের বড়ো ছেলে হওয়ার দরুন এস্টেটের দায়িত্বটা নিক প্রমথেশ। শান্তিতে বাকি জীবন কাটাবেন গৌরীপুরে নিজের বাড়িতে বসে। কিন্তু প্রমথেশ সেটা চাননি। ব্রিটিশ সরকারের তরফে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব এলে প্রত্যাখ্যান করেন। ততদিনে রক্তে ঢুকে গেছে সিনেমা।
কলকাতায় গৌরীপুর হাউসে উপস্থিত হয়েছেন তাবড় সঙ্গীতশিল্পীরা। ততদিনে নিউ থিয়েটার্সে কাজ করতে শুরু করেছেন প্রমথেশ বড়ুয়া। একে একে সবাই গান ধরেছেন। জমে উঠেছে আসর। এবার তো প্রমথেশের পালা! সবাই এসে ধরলেন তাঁকে। ছোটো থেকে গানের চর্চা থাকলেও সেভাবে সবার সামনে গাইতেন না প্রমথেশ। কিন্তু বাকিরা এত জোরাজুরি শুরু করল, যে গাইতে বাধ্য হলেন তিনি। ভাগ্যিস! গান শেষ হওয়ার পর প্রমথেশকে জড়িয়ে ধরলেন কে এল সায়গল। এ কী গাইলেন বড়ুয়া সাহেব! অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে গানের যাত্রাও শুরু হল তাঁর।
বাংলা তো বটেই, ভারতীয় সিনেমার জগতে একের পর এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। সেবার তিনি গেছেন ইউরোপে, চিকিৎসার জন্য। গিয়ে দেখেন, বাংলা ও ভারতের প্রাণের পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও উপস্থিত। আলাপ হল কবিগুরুর সঙ্গে। তখনই চলে গেলেন ফ্রান্সে। সিনেমা নিয়ে আরও পড়াশোনা করবেন তিনি, শিখবেন নতুন নতুন কৌশল— এটাই লক্ষ্য। সেখানেই দেখলেন কী করে কৃত্রিম আলোর ব্যবহার করতে হয় সিনেমায়। বাংলায় ফিরে তৈরি করলেন নিজের ফিল্ম কোম্পানি, নাম ‘বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিট’। এই কোম্পানির প্রথম সিনেমা ‘অপরাধী’। শুধু বাংলা নয়, ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই সিনেমা এক মাইলস্টোন। বিদেশে যা যা শিখেছেন, সব এবার সিনেমায় প্রয়োগ করতে আরম্ভ করলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। ‘অপরাধী’ সিনেমা ও প্রমথেশ বড়ুয়ার হাত ধরে প্রথমবার ভারতীয় চলচ্চিত্র দেখল কৃত্রিম আলোর ব্যবহার।
আরও পড়ুন
প্রস্তাব ফেরালেন উত্তমকুমার, সেই চরিত্র লুফে নিয়েই বাজিমাত সৌমিত্রের
ক্যামেরা এবং শুটিংয়ের কায়দা নিয়েও বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন তিনি। কিন্তু জীবন বড়ো অদ্ভুত। গল্পের শেষ পর্যায় আরও একবার ফিরে দেখা যাক ‘দেবদাস’-কে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসটিকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। কাহিনিই শুধু নয়; তাঁর অভিনয়, চলচ্চিত্র নির্মাণ, ক্যামেরার কাজ— সমস্ত জায়গায় একটা দৃষ্টান্ত হয়ে রইল এই সিনেমাটি। আর প্রমথেশ? তিনি হয়ে গেলেন সবার ‘দেবদা’। প্রমথেশ বড়ুয়ার হাত ধরেই প্রথমবার রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহৃত হয়েছিল বাংলা সিনেমায়। একের পর এক বাঁক বদল, আর তাঁর কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেন একজন মানুষ— প্রমথেশ বড়ুয়া।
শোনা যায়, পরবর্তীকালে যখন উত্তমকুমারকে ‘দেবদাস’-এর চরিত্রে অভিনয় করার কথা বলা হয়েছিল; তিনি সবিনয়ে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। প্রমথেশ বড়ুয়ার জুতোতে তিনি পা রাখবেন না। মহানায়কের কাছে, দেবদাস আর প্রমথেশ বড়ুয়া যেন সমার্থক। ওরকম অভিনয় তিনি পারবেন না। সত্যিই, জীবনের একটা পর্যায়ে এসে মনে হয় অভিনেতা আর অভিনীত চরিত্র যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রমথেশ বড়ুয়াও তো বড়ো পরিবারের সন্তান ছিলেন। জীবনে একের পর এক প্রেম এসেছে; আর তিনিও পাগলের মতো খুঁজে গেছেন ভালোবাসাকে। আর ছিল সিনেমা। পরিবারের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল একটা সময়। অতিরিক্ত মদ্যপান শরীরের কাঠামোকেও একটু একটু করে ভেঙে ফেলছিল। তখন ঠিক যেন ‘দেবদাস’-এর ট্র্যাজিক নায়ক তিনি। তবুও তিনি অনন্য, তিনি কিংবদন্তি। আর রাজা তো ছিলেন জন্মের পর থেকেই। শরীর ভাঙতে ভাঙতে একসময় চলে এল খাদের ধারে। পারলেন না আর পর্দার ‘দেবদাস’। গৌরীপুর, কলকাতা, বম্বে এবং এই পৃথিবী থেকে বিবাগী হলেন বরাবরের মতো…
তথ্যসূত্র –
১) ‘ট্রেনের কামরায় মশারি টাঙিয়ে যেতেন’, ঊর্মি নাথ, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘‘দেবদাস’ গ্রাস করেছিল প্রমথেশকে’, পৌলমী শীল, বাংলার পর্ব
আরও পড়ুন
মোটা টাকার চাকরি ছেড়ে টালিগঞ্জে, প্রথম অভিনয়েই চমকে দিলেন ছবি বিশ্বাসকে
Powered by Froala Editor