সালটা ১৯৩২। ভারতের অন্যতম প্রধান ও জনপ্রিয় রেকর্ড প্রস্তুতকারী সংস্থা এইচএমভি-তে অডিশন দিতে এসেছেন এক তরুণ। রোগা ছিপছিপে চেহারা, স্বপ্ন সুরের ভেলায় ভেসে জীবন কাটিয়ে দেওয়া। সেই ছোট্ট বয়স থেকে সঙ্গীতকেই একমাত্র সঙ্গী করে নিয়েছেন তিনি। রেডিওতে গাইছেন একের পর এক পল্লীগীতি। আনুনাসিক গলাটি মানুষ একবারেই চিনতে পারেন। এইচএমভি-তে এসে সেই স্বপ্নের ভেলা যেন আরও একটু দূর এগোল। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। অডিশনে উৎরোতে পারলেন না তিনি। তাহলে এবার? কেউ বলেছিল, একটা দরজা বন্ধ হলে খুঁজে যায় আরও একটি দরজা। দেখা মেলে নতুন কোনো ঠিকানার। সেই বছরই হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস থেকে প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বেরোয় তাঁর। তারপর এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে ঠুংরি, অতঃপর ১৯৩৭ সালে ‘রাজগী’ সিনেমার মাধ্যমে সঙ্গীত পরিচালনার জগতে পা রাখা। আর বাকিটা শচীন দেববর্মণ নামের এক মিথের জন্মকথা, এক কিংবদন্তির বেড়ে ওঠা…
যদি বলা হয়, শচীন দেববর্মণ জন্মসূত্রে ছিলেন ‘রাজা’, তাহলে খুব একটা ভুল বলা হবে না। বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণ ছিলেন ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের সৎ ভাই। সিংহাসনের লড়াইয়ের থেকে অনেকটা দূরেই সরে গিয়েছিলেন তিনি। চলে এসেছিলেন কুমিল্লায়। সেখানেই ছিল নিজের ‘রাজপাট’। আর মা নিরুপমা দেবী ছিলেন মণিপুরের রাজবংশের কন্যা। ফলে, জন্মসূত্রেই ‘নীল রক্তের’ অধিকারী ছিলেন শচীন কর্তা। খুব সহজেই আগরতলা বা কুমিল্লায় রাজকীয় জীবন কাটাতে পারতেন। না, সেই পথে হাঁটেননি তিনি। যার গলায় এত নিখাদ মাটির টান, তিনি তো আর পাঁচজনের মতো সাধারণ জীবনই বেছে নেবেন! ত্রিপুরার প্রাসাদ ছেড়ে বেছে নেবেন শহরের ছোট্ট ঘর। ব্যর্থ হবেন; আবার নতুনভাবে নিজের রাস্তা খুঁজবেন। নয়তো দরদ দিয়ে বলবেন কী করে, ‘তুমি এসেছিলে পরশু, কাল কেন আসোনি’…
মাঠে ঘাটে ঘুরে লোকসঙ্গীতকে চিনেছিলেন শচীন কর্তা। তবে অমন সঙ্গীত প্রতিভার জন্য আরও বড়ো মঞ্চ তো অপেক্ষা করছিল! মুম্বাইয়ের সিনেমার জগতে এসেছিলেন সাধারণ একজন হয়ে। ১৯৭৫ সালে প্রয়াণের আগেই তিনি হয়ে যান কিংবদন্তি। মুম্বাই তো বটেই, বাংলা সিনেমার জগতও তাঁর ছায়া পেয়েছিল। নতুন করে সেই গানের কথা নাই বা বলা হল। সেসব তো শুধু শোনার জন্য। শচীন দেববর্মণকে শিরায় শিরায় উপলব্ধি করার জন্য…
জীবনের পথটা অনেক বেশি চড়াই-উতরাইয়ের। শচীন কর্তাও তো একজন রক্ত-মাংসের মানুষ। সমুদ্রের ঢেউ বারবার ধাক্কা খেয়েছে কঠিন পাথরে। অপমানিত হয়েছেন; অনেক সময় প্রতিবাদও করেছেন। মনে পড়ে ১৯৫০-এর কথা। অশোক কুমার ‘মাশাল’-এর শুটিং শুরু করেছেন। তাঁর ইচ্ছা, শচীন দেববর্মণ এই সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা করুন। সেইরকমই কথা ছিল। কিন্তু ততদিনে মুম্বাইয়ের পরিবেশের প্রতি একটা অশ্রদ্ধা চলে এসেছে শচীন কর্তার মনে। আর ভালো লাগছে না এখানে। এঁরা শিল্পী ও শিল্পের গুরুত্ব বোঝে না, খালি বক্স অফিস আর টাকা বোঝে। তাঁর নিজের তৈরি করা গানগুলো নিয়ে একের পর এক কথা শুনতে হয়েছে। বিরক্ত হয়ে পড়লেন। ‘মাশাল’-এর কাজটা নিলেন বটে, কিন্তু করতে ইচ্ছা করল না। এই সিনেমায় তাঁর সহকারী ছিলেন আরেক দিকপাল, মান্না দে। শচীন কর্তা, মান্না-কে ডেকে সমস্ত বুঝিয়ে নিজের বাক্স-প্যাঁটরা গোছাচ্ছেন। ফিরে যাবেন কলকাতায়, এখানে আর না।
ততক্ষণে এই খবর পৌঁছে গেছে অশোক কুমারের কাছে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ‘দাদামণি’ তিনি, সবাই তাঁকে সম্মান করে। তিনি বুঝতে পারলেন শচীন দেববর্মণের অবস্থা। এদিকে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, কলকাতা ফিরে যাবেন। ট্রেন ধরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন; এমন সময় উপস্থিত হলেন স্বয়ং অশোক কুমার। শচীন কর্তাকে বোঝালেন অনেকক্ষণ। শেষ পর্যন্ত ট্রেনটি আর ধরলেন না। ফিরে গেলেন মুম্বাইয়ের বাসায়। ইংরেজিতে বললে, এটাই ছিল ‘টার্নিং পয়েন্ট’। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি শচীন কর্তাকে। তাঁর সুরে এক হয়ে গেল পাহাড় আর সমতলের মাটি। বাংলা থেকে মুম্বাই— সর্বত্র তাঁর গানে মেতে উঠল শ্রোতা। এই মুম্বাই তাঁকে দিয়েছিল আরেক সন্তান— কিশোর কুমার। রাহুল দেববর্মণের থেকে আলাদা করে দেখতেন না কিশোরকে। দুজনে মিলে নানা গান উপহার দিয়েছেন একসময়। মৃত্যুর আগেও কথা বলেছেন কিশোরের সঙ্গে। ‘মিলি’ সিনেমার বিখ্যাত গান ‘বড়ি শুনি শুনি’-র পরিচালনার সময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন শচীন দেববর্মণ। হাসপাতালে ছুটে যান কিশোর কুমার। এভাবেই সুতো জুড়ে জুড়ে তৈরি হয়েছে এক বিরাট ক্যানভাস। সেই আকাশে ধ্রুবতারার মতো জ্বলছেন শচীন কর্তা।
তথ্যসূত্র-
১) ‘S D Burman wanted to quit Bollywood during Mashaal’, India.com
২) S D Burman thought of leaving Bollywood during Mashaal, Buisness Standard
৩) ‘The reluctant Mumbaikar’, Mumbai Mirror
আরও পড়ুন
শৈশব-কৈশোর কেটেছে এ-শহরেই, কেমন আছে রাহুল দেব বর্মণের কলকাতার ঠিকানা?
Powered by Froala Editor