বিগত এক দশকে সোশ্যাল মিডিয়া তো বটেই, সংবাদমাধ্যমের পাতায় একাধিকবার উঠে এসেছে তাঁর নাম। না, কোনো সেলেব্রিটি নন তিনি। একজন সাধারণ সমাজকর্মী। নির্ভয়া কাণ্ড থেকে শুরু করে হাথরস কাণ্ড বার বার ধর্ষিতা, নির্যাতিতাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। সাধারণ মানুষের সামনে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন সমাজের অন্ধকার দিক, নির্যাতিতাদের অসহায়তার গল্প। যোগিতা ভায়ানা (Yogita Bhayana)। দিল্লির এই সামনের সারির সমাজকর্মী (Social Worker) ও নারী অধিকারকর্মীর (Women Rights Activist) ব্যক্তিগত জীবনের গল্পও বেশ অবাক করাই।
যোগিতার জন্ম এবং বড়ো হয়ে ওঠা রাজধানীতেই। সমাজকর্মী হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশও কৈশোরে। তখন বড়োজোর নবম কিংবা দশম শ্রেণির ছাত্রী যোগিতা। এককভাবেই দরিদ্র শিশুদের শিক্ষাদানের উদ্যোগ নেন তিনি। সেই থেকেই সমাজসেবার নেশা চেপে বসেছিল তাঁর মধ্যে।
দিল্লির গুরুগোবিন্দ সিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্নাতকতা করার পর, বিমান চালনার প্রশিক্ষণ নেন যোগিতা। আনুষ্ঠানিকভাবে সমাজকর্মী হিসাবে কাজ শুরু করা সেই সময় থেকেই। ততদিনে অবশ্য কিংফিশার এয়ারলাইন্সে চাকরিও পেয়ে গেছেন তিনি। ২০০২ সাল সেটা। ক্লাস থেকে ফেরার সময় এক ভয়ঙ্কর পথ দুর্ঘটনার সাক্ষী হন তিনি। তবে অবাক করার বিষয় হল, এই মর্মান্তিক ঘটনা দেখেও সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি পথচলতি মানুষের ঢল। শেষ পর্যন্ত, এক বন্ধুর সহযোগিতায় ওই ব্যক্তিতে হাসপাতালে নিয়ে যান যোগিতা। তবে প্রাণ বাঁচাতে পারেননি তিনি। অবশ্য সেখানেই থেমে থাকেননি যোগিতা। আইনি লড়াইয়েও ক্রমাগত পাশে দাঁড়িয়েছেন ওই ব্যক্তির পরিবারের। বিমানচালিকা হওয়া সত্ত্বেও ছুটি নিয়ে সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন সংশ্লিষ্ট পরিবারটিকে।
সেই সময়েই তিনি প্রত্যক্ষ করেন, আইনি প্রক্রিয়া ঠিক কতটা জটিল। এই মামলার নিষ্পত্তির পরে, ২০০৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের সাহায্যের জন্য এবং হাসপাতাল সংস্কারের জন্য আস্ত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন যোগিতা। ইতি টানেন নিজের উজ্জ্বল কেরিয়ারে। পাশাপাশি নারীদের কর্মসংস্থান করাও অন্যতম লক্ষ্য ছিল তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘দাস চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশন’-এর। তবে আজ পর্যন্ত সরকারের থেকে কোনোরকম সাহায্য নেননি যোগিতা।
আরও পড়ুন
উত্তরপ্রদেশে প্রতি ৩ ঘণ্টায় একটি ধর্ষণ, বাংলার নারী-সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন আদিত্যনাথ!
তাঁর কাজের গতিপ্রকৃতি পাল্টে যায় বছর চারেক পর। ২০১২ সাল। দিল্লির বুকেই ঘটে যায় নৃশংস নির্ভয়া কাণ্ড। ভয়াবহ গণধর্ষণের খবরকে প্রকাশ্যে তুলে ধরতেই প্রচার শুরু করেন যোগিতা। সক্রিয়ভাবে অংশ নেন একাধিক অবস্থান, প্রতিবাদে। তবে সেই কাজ করতে গিয়েই তাঁর সামনে খুলে যায় নতুন একটি দরজা। তৎকালীন সময়ে টেলিভিশন কিংবা সংবাদমাধ্যমে তিনি অত্যন্ত পরিচিত মুখ হয়ে ওঠায় একে একে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে আরও আট-ন’টি নির্যাতিতার পরিবার। নির্ভয়া কাণ্ড ততদিনে গোটা দেশের নজর কাড়লেও, অন্যান্য ঘটনাগুলি প্রায় ধামাচাপা পড়েই রয়ে গিয়েছিল লাল সুতোর ফাঁসে।
আরও পড়ুন
বিবাহেই কি বিচার পাবেন ধর্ষিতা? সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে
না, হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি যোগিতা। ধর্ষিতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তাঁদের কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্থা করেন তিনি। তারপর শুরু হয় আইনি লড়াই। নিজেও বিস্তারিত গবেষণা শুরু করেন ধর্ষণ এবং ভারতে নির্যাতন সম্পর্কিত আইনগুলি নিয়ে। সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে চিকিৎসা প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পুলিশের তদন্ত এবং বিচার— প্রতিটি স্তরেই আলাদা আলাদা করে আরটিআই করেন যোগিতা। এক আদালত থেকে আরেক আদালতে ছুটে বেড়াতে হত তাঁকে সারাদিন। এই কাজ যে তাঁর একার দ্বারা সম্ভব নয়, তা ভালোই বুঝেছিলেন যোগিতা। তাই মহিলা সুরক্ষা এবং সুবিচারের জন্য পৃথক একটি সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি। ‘পিপল এগেইনস্ট রেপ ইন ইন্ডিয়া’। মানসিকভাবে নির্যাতিতাদের পাশে দাঁড়ানো থেকে আইনি লড়াই— সমস্ত রকমভাবেই যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে যোগিতার এই স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে এই সংস্থার শাখা সংগঠন ‘উই মেন’ দায়ভার নিয়েছে নারী সুরক্ষার। রাতের শহরে টহল দেন এই সংগঠনের পুরুষ স্বেচ্ছাসেবকরা।
আরও পড়ুন
ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচাবে করাল দাঁত, অভিনব ‘রেপ-এক্স’ কন্ডোম আবিষ্কার চিকিৎসকের
বিগত দশ বছরে যোগিতা অসংখ্য মামলা দায়ের করলেও, এখনও পর্যন্ত সুবিচার পেয়েছেন মাত্র কয়েকজন। তার অন্যতম কারণ হল দীর্ঘ ও জটিল আইনি প্রক্রিয়া। তাই সুবিচারের আশ্বাস নয়, তাঁর মূল লক্ষ্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষগুলির পাশে দাঁড়ানো। সেই লক্ষ্যে অবিচল থেকেই লড়াই করে চলেছেন তিনি। লড়াই করে চলেছেন সমাজের মানসিকতা বদলেরও। জয় আসবেই…
তথ্যসূত্রঃ
She Quit Her Thriving Career In Aviation To Help Hundreds Of Rape Victims Get Justice, Divya Sethu, The Better India
Powered by Froala Editor