‘এলিফ্যান্ট হুইসপারার’ যেন সত্যজিতের সুজন হরবোলা, বন্য হাতিরাও শোকপ্রকাশ করেছিল তাঁর মৃত্যুতে

সত্যজিৎ রায়ের ‘সুজনের রূপকথা’-র কথা মনে আছে? অর্থাৎ, সেই সুজন হরবোলার কথা। যে সারাদিন ঘুরে বেড়াত মাঠে-ঘাটে। আর নকল করত পাখি ও নানান জীবজন্তুর ডাক। তাদের ডাক স্বর শুনেই চিনতে পারত সুজন হরবোলা। আর পশু-পাখিরাও বুঝত তার কথা। চলত এক অতিমানবিক কথোপকথন। তবে সত্যজিতের গল্পের সুজন চরিত্র রয়েছে বাস্তব পৃথিবিতেও। 

লরেন্স অ্যান্টনি। এই পরিবেশকর্মী, সংরক্ষক এবং অন্বেষকের নাম হয়তো অনেকেরই জানা। তবে বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই তিনি পরিচিত ‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইসপারার’ নামে। কিন্তু এই নামের পিছনে কোন ঘটনা লুকিয়ে? 

দক্ষিণ আফ্রিকার থুলাথালা ব্যক্তিগত সংরক্ষণভূমির দায়িত্বপালন করেছেন লরেন্স। বছর কুড়ি আগে দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকটি গ্রামে একপ্রকার তাণ্ডব চালিয়েছিল একদল হাতি। ফলত তাঁদের বন্দি করে রেখেছিলেন আধিকারিকেরা। তবে সেই বন্দিদশা ভেঙে বেরিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছিল হাতিগুলি। লরেন্স এই বন্যদানবদের সঙ্গে প্রথমবারের সাক্ষাতেই বুঝে যান তার পিছনে লুকিয়ে থাকা গল্প।

যেকোনো হাতির দলকে নিয়ন্ত্রণ করে একটি মাদি হাতি। মানুষের মতোই বন্য হাতিদের রয়েছে সমাজব্যবস্থা। তবে তা মাতৃকেন্দ্রিক। সংশ্লিষ্ট হাতির পালের সেই হস্তিনীটিই কয়েকদিন আগে চোরাশিকারীদের হাতে নিহত হয়েছে বুঝতে অসুবিধা হয়নি অ্যান্টনির। কার্যত মানুষের উপস্থিতি তাদের সন্ত্রস্ত করে তুলছে। করে তুলছে হিংস্র, আক্রমণাত্মক। 

তারপরেই ঘটে যায় এক অদ্ভুত ঘটনা। হাতির স্বরেই অ্যান্টোনির কথোপকথন চলে বন্দি থাকা হাতির পালটির সঙ্গে। আর তাতে অবিশ্বাস্যভাবেই শান্ত হয়ে যায় হাতির দলটি। তবে হাতিগুলিকে আবার মুক্ত অরণ্যে ফিরিয়ে দিতে রাজি হননি অ্যান্টনি। তাদের জায়গা হয় তাঁর তৈরি করা কয়েক একরের ন্যাচারাল রিজার্ভে। হাতিগুলিও স্বানন্দে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল। এই ঘটনার পর থেকেই অ্যান্টনি’র নাম হয়ে যায় ‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইসপারার’। সারা পৃথিবীতে রীতিমত সাড়া পড়ে যায় তাঁকে নিয়ে।

২০১২ সালে হৃদরোগে আকস্মিক মৃত্যু হয় অ্যান্টনির। বয়স হয়েছিল মাত্র ৬২ বছর। এই আকস্মিক মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল পরিবারে। নেমে এসেছিল সারা থুলাথালা সংরক্ষণভূমি জুড়েই। ঘটে গিয়েছিল আরও এক অস্বাভাবিক ঘটনা। সেদিন তাঁর ছোট্ট কটেজে ভিড় জমিয়েছিল উদ্ধার করা হাতির দলটি। ‘প্রিয়জন’ হারানোর যন্ত্রণায় শোকপ্রকাশ করেছিল তারাও। হয়তো অ্যান্টনির ফিরে আসার জন্যই অপেক্ষা করেছিল দু’দিন। 

পোষ্য জীবদের মধ্যে অনেক সময়ই সংবেদনশীল মনভাব লক্ষ্য করা যায়। কুকুর, বিড়াল প্রভৃতি প্রাণীদের সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিনের যোগাযোগ নতুন কিছু নয়। আবেগ প্রকাশ করতে দেখা যায় তাদেরও। কিন্তু বন্যপ্রাণীদের? সত্যজিতের গল্পের সুজন কিংবা বাস্তবের লরেন্স অ্যান্টোনির মতো চরিত্ররা সেই অদেখা দিকটারই ছবি ফুটিয়ে তোলেন যেন...

Powered by Froala Editor