প্রকৃতির কোলেই বসবাস তাঁদের। তা সত্ত্বেও দূষণের কোপ থেকে রেহাই মিলল না লাটিন আমেরিকার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মানুষদের। ভয়ঙ্কর মাত্রার পারদ দূষণে জর্জরিত বলিভিয়া, ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা এবং কলোম্বিয়া— লাতিন আমেরিকার এই চার রাষ্ট্র। আর বিশেষভাবে এই নিউরোটক্সিক পদার্থের প্রভাব ক্ষতিগ্রস্ত করছে গর্ভবতী মহিলা এবং ভ্রুণের স্বাস্থ্যকে। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এল সাম্প্রতিক গবেষণায়।
আন্তর্জাতিক দূষক নির্মূলীকরণ সংস্থা আইপেন এবং বায়োডাইভার্সিটি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের যৌথ প্রচেষ্টায় গোটা দক্ষিণ আমেরিকা জুড়েই চালানো হয়েছিল এই সমীক্ষা। প্রতিটি দেশেরই প্রায় শতাধিক গর্ভবতী মহিলার চুলের নমুনা সংগ্রহ করে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেইনের বিআরআই ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করেন বিজ্ঞানীরা। আর তার ফলাফল আসে চমকে দেওয়ার মতোই। গবেষকরা জানাচ্ছেন মহিলাদের দেহে পারদের স্তরে ০.৫৮ পিপিএম অতিক্রম করলেই তা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায় ভ্রুণের বিকাশের জন্য। আর ল্যাটিন আমেরিকায় সেই মাত্রা কোথাও কোথাও পৌঁছে গেছে ৭ পিপিএমের কাছে।
সমীক্ষায় দেখা যায় ৫৮.৫ শতাংশ মহিলাদের ক্ষেত্রেই বিপজ্জনক সীমা অতিক্রম করে গেছে পারদের মাত্রা। সবথেকে খারাপ অবস্থা বলিভিয়াতে। উত্তরপূর্ব ও মধ্য বলিভিয়ায় বসবাসরত এইয়ো কুইবো এবং পোর্তাচুয়েলো জনগোষ্ঠীর মহিলাদের শরীরে পারদের মাত্রা প্রায় ৭.৫ পিপিএমের বেশি। যা ভয়ঙ্কর বললেও কম বলা হয়। ব্রাজিল, কলোম্বিয়া-সহ অন্যান্য দেশগুলিতে পারদের মাত্রার গড় মান ২.৯৮ পিপিএম।
মূলত কল-কারখানার বর্জ্য পদার্থ এবং ইলেকট্রনিক বর্জ্য থেকেই পারদ দূষণ ছড়িয়ে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, সভ্য সমাজ থেকে দূরে থাকার পরেও কীভাবে পারদ দূষণের শিকার হচ্ছে আমাজনের এই জনগোষ্ঠীগুলি? গবেষকরা জানাচ্ছেন এক্ষেত্রে পারদ দূষণের মূল উৎস হয়ে উঠেছে গোটা ল্যাটিন আমেরিকাজুড়ে বৈধ ও অবৈধ স্বর্ণখনিগুলি। সোনা খাদানের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে পারদের ব্যবহার করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলিতে। খনি থেকে পারদ মিশ্রিত জল সরাসরি মিশছে নদীতে। আর সেখান থেকেই মূলত ছড়াচ্ছে দূষণ।
আরও পড়ুন
বিশ্বের ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক দূষণের জন্যই দায়ী ২০টি বহুজাতিক সংস্থা!
আমাজনের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মানুষদের জীবন মূলত এই নদীর ওপরেই নির্ভরশীল। তাঁদের খাদ্যাভ্যাসের একটি বড়ো অংশ হল নদীর মাছ। আর জলদূষণের কারণে ৯৫ শতাংশ মাছের দেহেই রয়েছে পারদের আধিক্য। স্বাভাবিক রান্না তো দূরের কথা, সেই মাছ সরাসরি আগুনে ঝলসে নিলেও মিথাইল-মার্কারির রূপে থাকা পারদ অপসারণ করা প্রায় অসম্ভব। ফলত ক্রমশ প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মানুষেররা আক্রান্ত হচ্ছেন পারদ-জনিত রোগে। পাশাপাশি এই দূষণ নদী বাহিত হওয়ায়, যেখানে স্বর্ণখনির অস্তিত্ব নেই সেখানেও ছড়িয়ে পড়ছে রোগের প্রকোপ।
আরও পড়ুন
ছাইঢাকা গোটা অঞ্চল, এন্নোর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষণে বিপর্যস্ত গ্রামবাসীরা
তবে খননের ক্ষেত্রে পারদের ব্যবহার বন্ধ করে দিলে অনেকটাই আয়ত্তে আসবে পারদের মাত্রা, সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ আশাবাদী গবেষকরা। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়ার সদিচ্ছাই নেই প্রশাসনের মধ্যে। এমনকি সংশ্লিষ্ট চারটি দেশেই সরকারিভাবেই বৈধতা দেওয়া হয়েছে পারদের ব্যবহারকে। ইতিমধ্যেই প্রতিটি দেশের সরকারের কাছে এই নীতি বদলের আবেদন করেছেন গবেষকরা। প্রতিবাদ আন্দোলনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবেশকর্মীরা। কিন্তু এতকিছুর পরেও কি বদলাবে পরিস্থিতি? সেই জায়গাটায় থেকেই যাচ্ছে সন্দেহ…
আরও পড়ুন
ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ির সমস্ত দূষণ শুষে নিতে পারে এই উদ্ভিদ!
Powered by Froala Editor