দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। শুরু হয়েছে নাৎসি যুদ্ধবন্দিদের বিচারের পালা। কিন্তু শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধই তো নয়, বিশ্বযুদ্ধেরও আগে থেকে ইহুদিদের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালিয়েছে তারা। নির্মমভাবে হত্যা করেছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। তবে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে অনেকাংশেই নাৎসিরা মুছে ফেলেছিল এইসব নথি। তাই তথ্য সংগ্রহ করতে ময়দানে নামতে হয়েছিল তাঁকে। সামনে থেকে দেখেছিলেন নাৎসিদের বীভৎসতার নমুনা। শেষ পর্যন্ত তাঁর পেশ করা প্রমাণের ভিত্তিতে শাস্তি হয়েছিল জার্মানির অন্যতম কুখ্যাত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বুচেনওয়াল্ডের ২২ অফিসারের।
বেঞ্জামিন ফেরেঙ্কজ (Benjamin Ferencz)। ১৯৪৬ সালের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ মামলা নুরেমবার্গ শুনানির শেষ জীবিত আইনজীবী ছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন বার্ধক্যজনিত অসুখে। গতকাল ১০৩ বছর বয়সে নিজের বাড়িতেই প্রয়াত হন কিংবদন্তি আইনজীবী এবং মানবাধিকারকর্মী।
মার্কিন নাগরিক হলেও, বেঞ্জামিনের জন্ম রোমানির ট্রান্সিলভেনিয়া শহরে। তবে ইউরোপের অস্থিতিকর রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই শরণার্থী হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা। সেখানেই বড়ো হয়ে ওঠা তাঁর। তবে ইউরোপ ছেড়ে আমেরিকাতে আশ্রয় নিলেও যুদ্ধ পিছু ছাড়েনি তাঁর। ১৯৪১ সালে জাপানের পার্ল হার্বার আক্রমণের পর আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তখন তরুণ তরুণীরা ঝাঁকে ঝাঁকে নাম লেখাচ্ছেন সেনাবাহিনীতে।
১৯৪৩ সাল। সদ্য স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর সেই তালিকাতেই নাম লিখিয়েছিলেন বেঞ্জামিন। দেশ ছেড়ে পাড়ি দিতে হয়েছিল নর্ম্যান্ডিতে। বছর দুয়েক নর্ম্যান্ডির যুদ্ধক্ষেত্রেই কাটিয়েছেন তিনি। সামনে থেকে দেখেছেন যুদ্ধের ভয়াবহ ছবি। জয় করেছেন প্রাণহানির আশঙ্কাকে। পরবর্তীতে নিতান্ত পদাতিক সেনা থেকে সার্জেনের পদেও উন্নীত হন বেঞ্জামিন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশে ফিরে আইনকেই জীবিকা হিসাবে বেছে নেন তিনি। শুরু করেন প্র্যাকটিস। তবে মাস কয়েকের মধ্যেই সরকার ফের ডাক পাঠায় তাঁকে। আইনি লড়াই লড়তে হবে বুচেনওয়াল্ডের নাৎসি অফিসারদের বিরুদ্ধে। তবে শুধু আইনি লড়াই-ই নয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ সংগ্রহ এবং তদন্ত কমিটিরও অন্যতম অংশ ছিলেন তিনি।
উল্লেখ্য, নুরেমবার্গ শুনানির সেই কমিটির অন্যতম কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন বেঞ্জামিন। সে-সময় তাঁর বয়স মাত্র ২৭ বছর। তা সত্ত্বেও তাঁর পেশ করা নথি ও বক্তব্যের জেরেই শেষ অবধি দোষী সাব্যস্ত করা হয় ২২ জন নাৎসি অফিসারকে। যার মধ্যে ফাঁসি হয়েছিল ১৩ জনের। শুধু তাই নয়, সে-সময় দীর্ঘদিন পশ্চিম জার্মানিতে কাটিয়েছেন তিনি। ইহুদি জনগোষ্ঠীর মানুষদের ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন এবং সহায়তা প্রদানের জন্য একাধিক মামলা লড়েছেন তিনি।
পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার পর আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপনা করেন বেঞ্জামিন। এমনকি যুদ্ধাপরাধে জড়িত নেতাদের বিচারের জন্য, বিশেষ আন্তর্জাতিক আদালতের প্রয়োজন— তিনিই প্রথম এই দাবি তুলেছিলেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একাধিক গ্রন্থও রয়েছে তাঁর। এর প্রায় কয়েক দশক পর ২০০২ সালে নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক আদালত। তার পিছনেও বড়ো ভূমিকা ছিল বেঞ্জামিনের। যদিও এই আদালতের আইনকানুন আজও স্বীকার করে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া-সহ একাধিক শক্তি। ফলে, এই আদালত আদৌ কতটা বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান হয়ে উঠতে পেরেছে— তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই গেছে। তবে এসবের বাইরে গিয়ে আন্তর্জাতিক শান্তিপ্রতিষ্ঠা কিংবা সাম্য ফেরানোর ক্ষেত্রে বেঞ্জামিনের উদ্যোগ অনস্বীকার্য। বলতে গেলে তাঁর প্রয়াণে মুছে গেল পৃথিবীর ইতিহাসের এক জীবন্ত অধ্যায়…
Powered by Froala Editor