জুটি বেঁধে বাংলা গান, চলে গেলেন জনপ্রিয় ‘কার্তিককুমার-বসন্তকুমার’-এর শেষজনও

শুক্রবার, ২৬ জুন। সেদিনই দুপুরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন গত শতকের জনপ্রিয় ‘কার্তিককুমার–বসন্তকুমার’ গায়ক জুটির বসন্ত দাস। একুশ বছর আগে অকালেই চলে গিয়েছিলেন প্রথম জন। কার্তিক দাস ছিলেন বসন্তেরই বড়ো ভাই, তাঁর চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়ো। ষাট, সত্তর, আশির দশকে যখন কলকাতা ও মফস্বলে জলসার রমরমা ছিল, তখন মান্না, হেমন্ত, সন্ধ্যা, শ্যামল, আরতি, সতীনাথের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছিল ‘কার্তিককুমার–বসন্তকুমার’ জুটি।

এখন যাঁদের বয়স চল্লিশ পঞ্চাশের কোঠায়, তাঁদের অনেকেরই মনে পড়বে ‘নাম তার মল্লিকা কিংবা সে জুঁই’, ‘ওহে নন্দলাল’, ‘বাগবাজারের রসগোল্লা’, ‘সমবেত বন্ধুগণ’-এর মতো জনপ্রিয় গানগুলোর কথা। রেকর্ড ছাড়িয়ে ক্যাসেটের যুগ পর্যন্ত এই গানগুলো দিব্য রাজত্ব করেছে বাঙালির ঘরে বাইরে। এছাড়া রেডিও তো ছিলই মন কেমন করা দুপুরে বা রাতের দিকের অনুরোধের আসরে।

১৯৪৮ সালের সরস্বতী পুজোর দিন জন্ম। বসন্ত-পঞ্চমীর দিন জন্ম, তাই বসন্ত নাম রেখেছিলেন তাঁর বড়দা বলরাম দাস। বলরামবাবু নিজেও একজন সংগীত-সাধক ও সংগীত শিক্ষক। তিনি গান শিখেছিলেন রাইচাঁদ বড়াল ও তাঁর ভাইপো দুনিচাঁদ বড়ালের কাছে। কার্তিক ও বসন্তকে নিজের হাতে তালিম দিয়ে তৈরি করেছিলেন বলরামবাবু। এই জুটির প্রথম দুটি গানের রেকর্ড বেরিয়েছিল মেগাফোন থেকে ১৯৬৮ সালে। সুর দিয়েছিলেন বলরাম দাস নিজেই। আর গানটি লিখেছিলেন কে? প্রখ্যাত অভিনেতা জহর রায় লিখেছিলেন ওঁদের প্রথম রেকর্ডের গান। একপিঠে ছিল ‘রাবণ রাজা পেয়েছে কেমন সাজা’, অপর পিঠে ‘সাহেব বিবি তোমরা বাবু’। মেগাফোন থেকে তখন জহর রায়ের একের পর এক কমিক স্কেচের রেকর্ড বেরোচ্ছে। সেই সূত্রে ওঁদের দুই ভাইয়ের প্রথম রেকর্ড বেরোনোর ব্যাপারে তিনিই ছিলেন কাণ্ডারী। কলেজস্ট্রিট অঞ্চলের রাধানাথ মল্লিক লেনে জহর রায় ছিলেন ওঁদের নিকটতম প্রতিবেশী।

জহর রায় চলে গেছেন ১৯৭১ সালে। কিন্তু দুই পরিবারের মধ্যে হৃদ্যতা আজও অটুট। প্রসঙ্গত জানাই, জহর রায়ের জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ‘চৌরঙ্গী’ পত্রিকার হয়ে বলরামবাবু এবং বসন্তবাবুর সাক্ষাৎকার নিতে একদিন হাজির হয়েছিলাম ওঁদের বাড়িতে। ‘রাবণ রাজা’ গানটি সেদিন বসন্তকুমার খালি গলায় গেয়ে শুনিয়েছিলেন। তাঁর পাশে বসে তাঁরই গলায় এই গানটা শোনা ছিল এক বাড়তি পাওনা।

আরও পড়ুন
যদুভট্টের থেকে পালিয়ে বেড়াতেন রবীন্দ্রনাথ, স্বীকার করেছেন নিজের গানের সীমাবদ্ধতাও

 

আরও পড়ুন
‘শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি’, ভারত-চিন যুদ্ধে গানই হাতিয়ার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের

কিশোর বয়সে বসন্ত গাইতেন আশা ভোঁসলের গলায় আর কার্তিক কিশোরকুমারের গলায়। নজরুল-পুত্র কাজী সব্যসাচী ওঁদের গান শুনে বলতেন ‘বাংলার কিশোর-আশা’। পরিণত বয়সে দুই ভাই কিশোরকুমারের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন বাংলা ছবির প্লে-ব্যাকে। নব্বইয়ের দশকে বসন্তকুমার একটি বাংলা ছবিতে গায়কের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছেন এককভাবে। দুটি ছবিরই মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন রাহুল দেব বর্মন।

আরও পড়ুন
হেস্টিংসের সঙ্গে কলকাতায় এল পিয়ানো, ভারতচন্দ্রের গানে সুর তুললেন রুশ সাহেব

গানের পাশাপাশি ঢোল ও নাল বাজাতে পারদর্শী ছিলেন বসন্তকুমার। একবার এক জলসায় রাধাকান্ত নন্দীর কোনো কারণে আসতে দেরি হয়েছিল। মান্না দে সেদিন বসন্তকুমারকেই ডেকে নিয়েছিলেন তাঁর গানের সঙ্গে সঙ্গত করার জন্য। অকৃতদার বসন্তকুমার আজীবন সংগীতের সঙ্গেই ঘর করে গেছেন। সৃষ্টি করেছেন অজস্র ছাত্রছাত্রী। দাদা কার্তিককুমার চলে যাওয়াতে তাঁদের জনপ্রিয় জুটি ভেঙে গিয়েছিল ঠিকই, তবে দাদার স্মৃতি নিয়ে বসন্তকুমার শ্রোতাদের আনন্দ দিয়ে গেছেন বরাবর।

আরও পড়ুন
‘বিবিধ গানে’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যদি নিজেকে আরও একটু বেশি করে দিতেন!

খুব প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন বসন্তকুমার। কথা হয়েছিল বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ওঁর গান বিষয়ে একটা ইন্টারভিউ নেব। সে সুযোগ আর হল না। শরীরে অসুস্থতার কোনো লক্ষণ আগে থেকে বুঝতেও পারেননি। হঠাৎই বুকে ব্যথা, হাসপাতালে যাওয়ার পথেই চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল তাঁর চিরবসন্ত কণ্ঠ।

আরও পড়ুন
লাইট ইন ব্যাবিলন ও কাঁটাতার পেরোনো গান

Powered by Froala Editor