রাজনৈতিক তর্কে বিতর্কেই হোক বা অন্য প্রসঙ্গে, সংবিধানের কথা চলে আসে আমাদের মাঝে। নানা সময় সংবিধান রক্ষার কথা বলি, সংবিধান সংশোধন নিয়ে বাক-বিতণ্ডা চলে টিভি চ্যানেলে। কিন্তু যারা প্রথম লোকসভার সদস্য হয়েছিলেন, সেই শুরুর দিন থেকে ভারতের সাধারণতন্ত্রকে বড়ো হতে দেখেছেন, এসব ব্যাপারে তাঁদের মতামত কী? ফিরতি প্রশ্ন আসতেই পারে, তাঁরা কি আর বেঁচে আছেন? সবাই না হন, একজন এখনও বেঁচে আছেন। শতায়ু টি এম কালিয়ান্নান হলেন সেই ইতিহাসেরই এক ও একমাত্র জীবিত শরিক।
আরও পড়ুন
সরকারের সমালোচনা, ১০২ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামীকে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা রাজনীতিকের
তামিলনাড়ুতেই বেড়ে ওঠা তাঁর। সেখানেই অংশ নেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামে। সময়টা ১৯৪২। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও চলছে তখন। গোটা দেশ উত্তাল। ভারত ছাড়তেই হবে ব্রিটিশদের। শুরু হল ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’। তামিলনাড়ুতে সেই সংগ্রামে অংশ নিলেন কালিয়ান্নান। একুশের রক্ত গর্জে উঠেছিল পরাধীনতার বিরুদ্ধে। ৪০০ জন ছাত্রের একটি মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এরাই লয়লা কলেজের প্রাঙ্গণে প্রথমবার জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। তারপরেই জীবনে আসে সেই দুর্লভ সুযোগ। আটজনের একটি দলের অংশ হয়ে হাজির হন সবরমতী আশ্রমে; গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে।
আরও পড়ুন
গোড়ালিতে পেরেক ঢুকিয়ে দিল পুলিশ, তবু মুখ খুললেন না ইলা
ওই আশ্রমেই দশদিন ছিলেন তিনি। পরে তাঁর বক্তব্য, এই দশটি দিনই তাঁকে বদলে দেয়। গান্ধীজির জীবনাদর্শ বুঝতে শেখেন তিনি। নিজের ভেতর সেই প্রশান্তির একটা রেশ অনুভব করেন। ইংরেজি সাহিত্য তাঁর প্রিয় বিষয়। সেখানেই ফিরে যান। কলেজ পাশ করে, তারপর যুক্ত হন রাজনীতির সঙ্গে। এখানেই তাঁর আরও একটা দিক নজরে আনা দরকার। অনেক ছোটো বয়সেই কালিয়ান্নানকে দত্তক নেন কুমারমঙ্গলমরা। তাঁরা ছিলেন জমিদার মানুষ। কস্তুরিপাট্টি’র এস্টেটের উত্তরাধিকার হন তিনি। এককথায়, ঐশ্বর্য হাতে পাওয়া। কিন্তু গান্ধী-র শিক্ষা তাঁর মধ্যে একটা অন্যরকম মানুষকে জাগ্রত করে দেয়। শান্ত থাকার চেষ্টা, মানুষ হওয়ার চেষ্টা, সাহসী হওয়ার চেষ্টা— এই সবকিছুই ছিল সেই শিক্ষারই অঙ্গ।
আরও পড়ুন
দাবিদার ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, তাঁর মৃত্যুতে দেওয়া হল না নোবেল শান্তি পুরস্কারই
১৯৪৩-এ জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। তারপরের গল্পটা উত্তরণের। স্বাধীন ভারতের প্রথম গণপরিষদেও (১৯৪৮-১৯৫২) জায়গা হয়ে যায় তাঁর। ভারতের ফরেন অ্যাম্বাসাডরের দায়িত্ব নেওয়ার পর ডঃ সুব্রামনিয়মের আসনটি খালি হয়ে যায়। সেখানেই মাত্র ২৭ বছর বয়সে নির্বাচিত হন কালিয়ান্নান। বি আর আম্বেদকরের সঙ্গে সংবিধানের ড্রাফটিং কমিটিতে কাজও করেন তিনি। নিজের চোখের সামনে একটু একটু করে তৈরি হতে দেখেন বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো গণতন্ত্রের শিরদাঁড়াকে। ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি সংবিধান কার্যকর হলে তিনি পার্লামেন্টের অন্যতম সদস্যও হন। ঠিক দু’বছর পর, ১৯৫২ সালে ভারতের প্রথম ভোটেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। তামিলনাড়ুর রাসিপুরম কেন্দ্র থেকে তিনি জেতেনও। এই সময়ই জমিদারি প্রথা উঠিয়ে দেওয়ার জন্য পাশ করা হয় একটি বিল। নিজে সেই জমিদারি ব্যবস্থার অংশ হয়েও, স্বাগত জানান একে।
আরও পড়ুন
বুকে ভাষাশহীদের স্মৃতি, শতবর্ষে পা বনহুগলি লাইব্রেরির
তামিলনাড়ুর অনেক জায়গায় শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য তাঁর নিরলস কাজ আজও মনে করেন মানুষ। নিজে তো বটেই, তাঁর অফিসাররাও গ্রামে গ্রামে চলে যেত অবস্থার পরিদর্শনে। যা দেখতেন, তৎক্ষণাৎ সঙ্গে থাকা টাইপরাইটারে টাইপ করে রিপোর্ট করে নিতেন। এইভাবেই তৈরি হত একের পর এক মিরাকল! লাইব্রেরি, স্কুল তৈরি তো বটেই, মেয়েরাও যাতে এগিয়ে আসে সমাজের কাজে, সেটাও দেখতেন তিনি। ঘরে বসে থেকে নয়, মাঠে নেমে হাতে কলমে দেখাতেই বিশ্বাসী ছিলেন কালিয়ান্নান।
আরও পড়ুন
কয়েকটি মাত্র শব্দ জুড়ে জুড়ে ধর্মসংগীতকে প্রতিবাদের গানে বদলে নিলেন পিট সিগার
আজ, শতবর্ষে দাঁড়িয়ে সংবিধানের সেই আবহমান পতাকাই একা বহন করে চলেছেন টি এম কালিয়ান্নান। নিজের চোখে যে সংবিধানকে তৈরি হতে দেখলেন, নিজেও তো সেই প্রক্রিয়ার অংশ ছিলেন; আজ দেশের এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সংবিধানকে কি সুরক্ষিত মনে হচ্ছে তাঁর? কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। তবে এখনও আশাবাদী তিনি। এখনও শান্তিতেই বিশ্বাস করেন। যাই হয়ে যাক, একদিন আবার আলো আসবে, সমস্ত জায়গার অন্ধকার কাটবে, প্রার্থনা তাঁর।