জীবনের ৬৮টা বছর একটি লোহার ফুসফুসের মধ্যে কাটিয়েছেন পল আলেকজান্ডার। মাত্র ৬ বছর বয়সে নিজস্ব শ্বাসক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু জীবনের যুদ্ধ থেমে যায়নি। করোনা পরিস্থিতিতে আবারও সংক্রমণের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন টেক্সাস স্টেটের এই বাসিন্দা। মনে পড়ে যাচ্ছে শৈশবের সেই দিনগুলির কথা। আর এখন সারা পৃথিবীতে তিনিই একমাত্র মানুষ, যিনি লোহার ফুসফুসের সাহায্যে বেঁচে রয়েছেন। পল আলেকজান্ডারের সেইসব অভিজ্ঞতার কথা সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে আমেরিকার বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে।
১৯৫২ সালের গ্রীষ্মকালে এখনকার মতোই লকডাউন শুরু হয় টেক্সাস স্টেটে। লকডাউনের কারণ এক ভয়ঙ্কর মহামারী। পোলিও। টিকা তো দূরস্থান, রোগের উৎসই খুঁজে পাচ্ছেন না চিকিৎসকরা। মশাবাহিত রোগ নয়। কিন্তু কীভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। ঠিক এই সময় একদিন বাড়ির বাগানে খেলতে খেলতে হঠাৎ নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল ৬ বছরের পলের। সেইসঙ্গে মাথায় অসহ্য ব্যথা। কোনোরকমে বাড়ির ভিতরে গিয়ে মায়ের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ল পল। গায়ে তখন ধুম জ্বর। সেই রাতটা বাবা-মায়ের সঙ্গেই কাটল। রাতের দিকে কিছুটা সুস্থও হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পরেরদিন সকাল থেকেই হাতে-পায়ে আর জোর নেই। শ্বাস নিতে আবার কষ্ট শুরু হল। রোগটা যে পোলিও, সেটা বুঝতে আর বাকি রইল না।
তিনদিন পর যখন পলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল, তখন ডাক্তাররা জানালেন তার বাঁচার আর কোনো আশা নেই। তবে ঠিক এই সময়েই আরেক ডাক্তার এসে প্রায় জোর করেই নিয়ে গেলেন পলকে। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবেন তিনি। প্রথমেই অপারেশন করে বের করলেন ফুসফুসের ভিতর জমে থাকা দূষিত বাতাস। তারপর লোহার তৈরি কৃত্রিম ফুসফুসের সাহায্যে শুরু হল শ্বাসকার্য। আরও তিনদিন অজ্ঞান হয়ে ছিল পল। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন দেখল একটা বিরাট ঘরে সারি সারি শুয়ে আছে প্রায় জনা কুড়ি তারই বয়সি ছেলেমেয়ে। প্রত্যেকের গলা থেকে নিচের সমস্ত শরীর লোহার যন্ত্রের আচ্ছাদনে ঢাকা। দেখতে দেখতে একের পর এক শিশুর মৃত্যু হতে থাকল তারই চোখের সামনে। তবে পল কোনোরকমে বেঁচে গেল। ১৮ মাস পর বাড়ি ফিরেও এল। কিন্তু নিজে থেকে শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা তখনও জন্মায়নি। ভরসা সেই লোহার ফুসফুস।
এরপর প্রতিবন্ধকতা নিয়েও ক্রমশ সুস্থ জীবনে ফিরে আসার লড়াই চালিয়ে গিয়েছে সেই ৬ বছরের বালক। স্কুলের পড়াশোনা শুরু হল কিছুদিনের মধ্যেই। একটু একটু করে মুখের মাধ্যমে শ্বাসপ্রশ্বাস চালাতেও শিখেছে। তবে তা ওই কয়েক মিনিট পর্যন্ত। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে বহু তদবির করে কলেজেও ভর্তি হন। তারপর আইন নিয়ে পড়াশোনা। শুধু তাই নয়, দালাস আদালতে রীতিমতো মামলাও লড়েছেন পল আলেকজান্ডার। আইন ও অন্যান্য বিষয়ে লিখেছেন বেশ কিছু বই। আমেরিকায় তখন শারীরিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের রাস্তায় বেরনোর কথা কেউ ভাবতেই পারত না। শারীরিক প্রতিবুন্ধকতাযুক্ত মানুষদের অধিকার বিষয়ক আইনের প্রথম খসড়া তৈরি হয়েছিল ১৯৯০ সালে। তার বহু আগে এমন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন পল।
আরও পড়ুন
সংক্রমণ-পরবর্তী ৫-১০ দিনকে বিশেষ গুরুত্ব দিন, পরামর্শ চিকিৎসকদের
এখন মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাও ক্রমশ হারিয়ে ফেলছেন পল। সারা বছরে মিনিট পাঁচেকের বেশি লোহার ফুসফুসের বাইরে থাকতে পারেন না। তবু জীবনের আশা ছেড়ে দেননি পল। তিনি জানেন, ঘরের মধ্যে করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা তাঁর নেই। তবু আরেক মহামারীর শিকার হতে চান না। বেঁচে থাকার মধ্যেই যে একটা অদ্ভুত তৃপ্তি আছে।
আরও পড়ুন
‘আইভারমেকটিন’ ম্যাজিক ড্রাগ নয়, ডেকে আনতে পারে বিপদও; জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
‘লোহার ফুসফুস’ থেকে আজকের ভেন্টিলেটর, যে বিজ্ঞান মানুষকে বাঁচিয়েছে বারবার