দৈর্ঘ্য প্রায় পাঁচ ফুট। ওজন প্রায় একশো থেকে দেড়শো কেজি। অথচ এই দৈত্যাকার কচ্ছপের পিঠে শক্ত খোলস নেই কোনো। বরং, তাদের পিঠ ঢাকা নরম মোটা চামড়ায়। জীববিজ্ঞানের পরিভাষায় এ-ধরনের প্রজাতিকে বলা হয় ‘সফটশেল টার্টল’। সাধারণত সামুদ্রিক পরিবেশেই এই কচ্ছপদের বেশি দেখা গেলেও, ব্যতিক্রম রয়েছে তার। যেমন দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন ও তার শাখানদী-জুড়ে বসবাস এমনই বহু কচ্ছপ প্রজাতির। দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশেও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সফটশেল টার্টলের প্রজাতি। এবার পৃথিবীর বুক থেকে অবলুপ্ত হওয়ার প্রহর গোনা শুরু করল এমনই একটি দৈত্যাকার কচ্ছপ প্রজাতি।
ইয়াংজি সফটশেল টার্টল (Yangtze Softshell Turtle)। কেবলমাত্র ভিয়েতনামেই দেখা যায় এই বিশেষ প্রজাতির কচ্ছপের অস্তিত্ব। ক্রমাগত বাসস্থান ধ্বংস হয়ে যাওয়া, উন্নয়ন এবং সর্বোপরি শিকারের কারণে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল এই প্রজাতিটি। সংখ্যা কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৩টিতে। যার মধ্যে ছিল দুটি পুরুষ কচ্ছপ ও একটি মহিলা। গত ২৪ এপ্রিল প্রাণ হারাল ইয়াংজি প্রজাতির শেষ মহিলা কচ্ছপটি। ইতি পড়ল, গবেষকদের প্রজাতি সংরক্ষণ প্রকল্পেও।
গত ২৪ এপ্রিল উত্তর ভিয়েতনামে অবস্থিত ডং মো হ্রদের জলে ভেসে থাকতে দেখা যায় সংশ্লিষ্ট কচ্ছপটির দেহ। তা উদ্ধার করেন বনদপ্তরের কর্মীরা। পাঠানো হয় পরীক্ষার জন্য। তবে ঠিক কী কারণে মৃত্যু হল এই কচ্ছপটির— সে-ব্যাপারে এখনও কোনো সুস্পষ্ট তথ্য প্রকাশ্যে আনেনি ভিয়েতনামের গবেষক ও বনবিভাগ।
আজ থেকে ১৭ বছর আগের কথা। ২০০৬ সালে সংশ্লিষ্ট প্রজাতিটি সংরক্ষণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল ভিয়েতনাম সরকার এবং এশিয়ান টার্টল প্রোগ্রাম। তবে তারপরও বাস্তব অবস্থার উন্নতি হল না কোনো। আশ্চর্যের বিষয় হল, সাধারণত প্রতিবছর একসঙ্গে প্রায় ৩০টি করে ডিম পাড়ে ইয়াংজি প্রজাতির মহিলা কচ্ছপরা। তবে ক্রমাগত ডিম চুরি যাওয়ায় দীর্ঘ ১৭ বছরে কচ্ছপের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কেবলমাত্র ১টি। তবে পুরুষ কচ্ছপ হওয়ায়, বংশধারা এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম নয় সেটিও।
এই ঘটনা প্রাকৃতিক বিপর্যয় তো বটেই, পাশাপাশি ভিয়েতনামের সংস্কৃতিতেও বড় প্রভাব ফেলতে চলেছে দৈত্যাকার এই কচ্ছপের বিলুপ্তি। আসলে ভিয়েতনামের স্থানীয় লোককথা এবং পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ইয়াংজি কচ্ছপ। ভিয়েতনামী পুরাণ অনুযায়ী, এই কচ্ছপ আদতে কচ্ছপ-দেবতা ‘কিম কুই’-এর প্রতিনিধি। হাজার বছর আগে যিনি চিনাদের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করতে সাহায্য করেছিলেন ভিয়েতনামীদের। ফলে, ইয়াংজি কচ্ছপদের বিলুপ্ত এই পৌরাণিক কাহিনির ভিত্তিকেও খানিকটা নাড়িয়ে দিল— তাতে সন্দেহ নেই কোনো।
অবশ্য আশা ছাড়ছেন না গবেষকরা। বর্তমানে পশ্চিম এশিয়ার ইউফ্রেটিস নদীতেও দেখা যায় ‘রাফেটাস ইউফ্রেটিকাস’ নামের দৈত্যাকার সফটশেল কচ্ছপের একটি প্রজাতি। ইয়াংজি কচ্ছপের জিনগত নিকটতম আত্মীয় হিসাবে ধরে নেওয়া হয় এই প্রজাতিকে। ইয়াংজির মতো আইইউসিএন রেডলিস্টে রয়েছে তারাও। তবে এই প্রজাতি পরবর্তীতে জেনেটিক ইঞ্জানিয়ারিং-এর মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে পারে ইয়াংজি কচ্ছপকে, ক্ষীণ হয়ে জ্বলে রয়েছে সেই আশা। সেই কাজ সহজ নয় মোটেই। তবে ইতিমধ্যেই এই সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন ভিয়েতনামের জীববিজ্ঞানীরা। পাশাপাশি এই প্রজাতির শেষ দুই পুরুষ সদস্যকে বাঁচিয়ে রাখতেও চলছে লড়াই।
মন্ট্রেয়ালে আয়োজিত কপ-১৫ বায়োডাইভার্সিটি কনফারেন্সে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সরকার জাতিসঙ্ঘের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বন্যপ্রাণী এবং প্রকৃতি সংরক্ষণের। চুক্তি হয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি দেশ বন্যপ্রাণীদের জন্য সংরক্ষিত অঞ্চল হিসাবে ঘোষণা করবে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ অঞ্চল। এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর আগেই যে বহু প্রজাতির অস্তিত্ব মুছে যাবে পৃথিবী থেকে, তা আরও একবার প্রমাণ করল সাম্প্রতিক ঘটনা…
Powered by Froala Editor