‘শেষ’। একটাই শব্দ। কখনও দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আসে, কখনও আবার আনন্দ। কারো-কারো কাছে কান্নাও। আবার, এই শব্দটাই যখন বইমেলার সঙ্গে জুড়ে যায়, বিষণ্ণতা ভর করে। আমার ও আমার মতো অসংখ্য মানুষের মনে। সত্যিই এ এক অভাবনীয় পার্বণ। দুর্গাপুজোর মতোই, বাঙালির সারাবছরের অপেক্ষা বইমেলার জন্য। যে তরুণ কবির প্রথম বই বেরোল এ-বছর, কিংবা যে জানে না আদৌ পরের বছর আর আসা হবে কিনা মেলায়, তাদের সবার কাছেই বইমেলা একটা আশ্রয়ের নাম। ‘মায়ের মতোই ভালো’।
ওই যে একে একে ফাঁকা হচ্ছে মেলার চত্বর, স্টলে-স্টলে প্রকাশনা কর্মীরা অপেক্ষা করছেন রাত্তির ন’টার ঘণ্টার, লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে বইপত্র গুছিয়ে তরুণ বন্ধুরা জড়িয়ে ধরছে একে অপরকে – বইমেলার শেষদিন এমন দৃশ্যের সাক্ষী। প্রত্যেক বছরই। বিজয়া দশমী ছাড়াও, বছরে একটা দিন বরাদ্দ থাকে, যেদিন হাজার-হাজার বাঙালি মনখারাপ পুষে বাড়ি ফেরে। এবারের মতো শেষ। একটা রোববার দাড়ি টেনে দিল এতদিনকার আয়োজনের। পরিশ্রমের। সমস্ত কাজ সেরে, তাড়াহুড়ো করে মেলায় ঢোকা নেই আর। নেই কাল সবার সঙ্গে দেখা হবে ভেবে উত্তেজনায় ফুটতে থাকা। আসছে বছর আবার হবে। সব এক থাকবে তো? বাঁধনগুলো?
বইমেলার একটা আশ্চর্য টান আছে। যে ভাই সুদূর প্রবাসে চাকরিরত, আসতে পারল না বইমেলায়, তার অভিমান জমা রইল এই লেখায়। জমা রইল অনেক স্বপ্ন নিয়ে বই করার পরও তেমন বিক্রি না হওয়া তরুণ কবিটির চোখ। কিংবা ‘রক্তমাংস’ পত্রিকার স্মৃতি, একজন গৌতম ঘোষ দস্তিদারের দীর্ঘশ্বাস। বইমেলা বুনতে বুনতে চলে এমন অসংখ্য গল্প। না-থাকা পিনাকী ঠাকুর, শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়, মণীন্দ্র গুপ্ত কিংবা নবনীতা দেবসেন – এই বইমেলা কি তাঁদেরও নয়?
ছলোছল চোখে তাকিয়ে রয়েছে ছেলেটি। গোটানো হয়ে গেছে টেবিল। এবার বেরোতে হবে। শেষবেলায় পাশে শুধু বন্ধুরা। কোনো-কোনো অগ্রজও। আবার কবে দেখা হবে? আদৌ হবে কি? হারিয়ে যাব না তো কেউ? প্রশ্ন জমছে মাথায়। গত তেরোদিন যেসব কথা মনেও আসেনি। আর কিছু হোক না হোক, শেষদিন তো দেখা হবেই! কিন্তু সেই শেষদিনও যখন শেষ হয়ে আসে, আস্তে আস্তে বন্ধ হতে থাকে একের পর এক স্টলের গেট, ফাঁকা হয়ে আসে লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়ন, বোঝা যায়, আগামীকালের অনেকটা শূন্য হয়ে গেল। আগামীরও কি?
এর উত্তর দেওয়ার সাধ্য কোনো মানুষের নেই। দিতে পারে একমাত্র বইমেলাই। অপেক্ষা শেখাতে শেখাতে, আমাদের নিয়ে যায় আরেকটা নতুন বছরে। আনন্দের পর, নতুন করে বিষণ্ণ করবে বলে...
ছবি - সমীরণ