২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা রাজপথে নেমেছিলেন মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে। পাকিস্তান পুলিশের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া আসতে দেরি হয়নি। পুলিশের গুলিতে রাজপথে শহীদ হলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার। ভাষার জন্য এমন মরণপণ লড়াই দেখে চমকে উঠেছিল পৃথিবী। ১৯৯৯ সালে এই দিনটিকেই 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে'র (International Mother Language Day) স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো (UNESCO)।
ঢাকার পড়ুয়াদের এই লড়াই সারা পৃথিবীর মানুষকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়েছিল। নিজেদের পরিচয়কে চিনতে শিখিয়েছিল। আর সেইসঙ্গে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিল। সেই প্রতিবাদের আগুন পৌঁছে গিয়েছিল আসামের বরাক উপত্যকায়। রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসাবে ঘোষণা করা হয় অসমিয়া ভাষাকে। এই সিদ্ধান্তই মানতে পারেননি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষী মানুষ। ১৯৬১ সালের ১৯ মে, হরতালের ডাক দেয় কাছার গণসংগ্রাম পরিষদ। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিতে শুরু হয়ে যায় হরতাল, পিকেটিং। আন্দোলন দমন করতে নামে আসাম পুলিশের বিশেষ বাহিনী আসাম রাইফেল। দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করেও দমানো যায়নি। অবশেষে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে প্রতিবাদীদের লক্ষ্য করে ১৭ রাউন্ড গুলি চালায় পুলিশ। রাজপথে লুটিয়ে পড়েন ১১ জন প্রতিবাদী।
তবে মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন না হলেও, ভাষার জন্য আন্দোলনের পটভূমি ব্রিটিশ ভারতেই তৈরি ছিল। যার যবনিকা উন্মোচন হয় ১৯৬৫ সালে তামিলনাড়ুতে। খালি চোখে সেটা ইংরাজি ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন মনে হলেও, আসলে তা ছিল হিন্দি আগ্রাসনকে প্রতিহত করার লড়াই। ১৯৩৭ সাল থেকেই সরকারি কাজে হিন্দি ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করেন দক্ষিণ ভারতের বিরাট অংশের মানুষ। এর মধ্যেই স্বাধীনতার পর হিন্দি ভাষাকে প্রধান রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হলে ক্ষোভ চরমে ওঠে। ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে হিন্দিকে মুখ্য রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ওঠে। তার আগের দিন, অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারি মাদুরাই শহরের রাজপথ দখল করে প্রতিবাদী জনতা। আবারও নেতৃত্বে পড়ুয়ারাই। আন্দোলন দমন করতে প্রথমে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। তারপর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চলে। জনতা-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধ দুজন পুলিশ অফিসার সহ ৭০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারান।
বঙ্গবন্ধু ঢাকার শহীদ মিনার থেকে থেকে আওয়াজ তুলেছিলেন, "আমরা চাই আমাদের মতোই পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠানরা নিজ নিজ অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকুক।" ধর্মের উপরে ভাষাগত ঐক্যকে তুলে ধরার আহ্বান বাংলাদেশ ভাষা আন্দোলনের। আন্দোলনের সেই সুরের প্রতিধ্বনি উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তানেও। পাকিস্তান, ইরান এবং আফগানিস্তান; এই তিন দেশের কাঁটাতারে বিভক্ত বেলুচ ভাষাভাষীর মানুষ। ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই আওয়াজ উঠেছিল স্বাধীন বেলুচিস্তান রাষ্ট্রের। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের পর সেই আওয়াজ আরও জোরদার হয়। কোন ধর্মীয় পরিচয় নয়, ভাষা ও ঐতিহ্যই স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের নিয়ামক বলে দাবি করেন প্রতিবাদীরা। আফগানিস্তান সরকার এই দাবিকে সমর্থন জানালেও ইরান এবং পাকিস্তান সরকার এই দাবি মানেনি। স্পষ্টত সম্পূর্ণ বিপরীত বক্তব্য থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম।
আরও পড়ুন
ঔপনিবেশিক স্মৃতি মুছে ‘আফ্রিকার ভাষা’ সোয়াহিলি
ভাষাগত ঐক্যকে অক্ষ করেই জাতিরাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানিয়েছিল ফরাসি বিপ্লব। ইউরোপের নানা জায়গায় এইভাবে ছোটো ছোটো জাতিরাষ্ট্র গঠন হয়েছিল। আবার অনেক জায়গাতেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে চলেছে দীর্ঘ লড়াই। পূর্ব ইউরোপের স্লাভ দেশগুলির ইলিরিয়ান ভাষা কৌলিন্যের মর্যাদা পায়নি কোনোদিন। উনবিংশ শতকের শুরু থেকেই নিজেদের ভাষার দাবিতে সরব হয়েছিলেন তাঁরা। কখনো কখনো স্লাভ জাতিয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে মিশে গেছে, কখনো বা জাতীয়তাবাদীরাও এই আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়াননি। প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন চলেছে, বিপরীতে কোথাও ইতালি, কোথাও ফ্রান্স, কোথাও আবার সোভিয়েত রাশিয়া।
আরও পড়ুন
ফেব্রুয়ারি মাসেই ভাষা আন্দোলনের ডাক ঝাড়খণ্ডে
ভাষার উপর আগ্রাসন প্রায় সমস্ত উপনিবেশের সাধারণ ঘটনা। শাসক জাতি সবসময় নিজেকে শাসিতের থেকে উন্নত বলে মনে করেছে, উন্নত মনে করেছে তার ভাষাকেও। উপনিবেশের উপর চাপিয়ে দিয়েছে তার ভাষাকে। ভারতে এই প্রক্রিয়া তেমন ভয়াবহ না হলেও, দক্ষিণ আফ্রিকার উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাতই কিন্তু ভাষার প্রশ্নকে সামনে রেখে। উনবিংশ শতকেই ডাচ ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন 'অন্ধকার' এই মহাদেশের পরাধীন মানুষরা। দাবি ছিল, আফ্রিকান ভাষাকে পৃথক সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দিতে হবে।
আরও পড়ুন
বিলুপ্তির মুখ থেকে বাঁচাতে কারিব ভাষায় পঠনপাঠনের উদ্যোগ তরুণ-তরুণীদের
১৮৭৫ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম আফ্রিকান ভাষার সংবাদপত্র। এরপর ইঙ্গ-বোর যুদ্ধে ইংরেজরা জয়লাভ করলে সেই আন্দোলন বাড়তি অক্সিজেন পায়। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রচেষ্টায় তৈরি হয় আফ্রিকান ভাষার স্কুল। অবশেষে ১৯২৫ সালে ইংরাজি ভাষার সঙ্গেই পৃথক সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয় আফ্রিকান ভাষাকেও। আর তারপর পুরো বিশ শতক ধরে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষদের উপর চলে অকথ্য অত্যাচার। ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে আসে আমেরিকার সামরিক বাহিনী। ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ভূমিপূত্ররা। সেইসঙ্গে আফ্রিকান ভাষা। নব্বইয়ের দশকে শুরু হয় নতুন ধারার ভাষা আন্দোলন। বিশ্বায়নের সূত্রকে স্বীকার করে নিয়েই নিজেদের জাতিসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেন মানুষ। সেই আন্দোলন তো এখনও চলছে।
আফ্রিকার মতোই অন্যান্য উপনিবেশেও ভাষাই হয়ে ওঠে জাতিসত্তার পরিচয়। ১৯১০ সালে জাপ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে কোরিয়ার যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুরু হয়, তারও অক্ষে ছিল ভাষার প্রশ্নটি। জাপ সামরিক বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন কত মানুষ, কেউ আবার নিজের দেশ ছেড়ে চিনে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেছেন। কিন্তু পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েও কোরিয়ার স্বাধীনতার কথা বলতে ভোলেননি তাঁরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও মিত্রশক্তির সাহায্য ছাড়াই জাপ সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায় কোরিয়ার পরাধীন মানুষরা। অবশেষে ১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধে জাপানের অন্তিম পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন হয় কোরিয়া।
কোরিয়ার সঙ্গেই জাপ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে তাইওয়ান ভাষাভাষীর মানুষদের। এমনকি চিনের স্বাধীনতা আন্দোলন বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরেও ছবিটা বদলায়নি। জাপানি আগ্রাসন রুখতে মান্দারিন ভাষাকেই বেছে নিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু সেইসঙ্গে অন্যান্য ভাষার মর্যাদাও দাবি করেছিলেন তাঁরা। ২০০১ সালে চিন সরকার মান্দারিনকে একমাত্র জাতীয় ভাষা ঘোষণা করলে পরিস্থিতি আবার জটিল হয়ে ওঠে। চিনের বিরাট ভূখণ্ডের অনেক ভাষাই তো আসলে মান্দারিনের সঙ্গে মেলে না।
শুধু উপনিবেশ কেন, ইউরোপের যুক্তরাজ্য কাঠামোর মধ্যেও একটি রাজ্যের ভাষা অন্য ভাষাকে গলে খেতে চেয়েছে। একদিকে আইরিশ ভাষার অধিকার চেয়ে ইংল্যান্ডের থেকে পৃথক হতে চেয়েছেন আয়ারল্যান্ডের মানুষ। অন্যদিকে নরওয়ের মানুষ মুক্তি চেয়েছেন ডেনমার্কের থেকে। উনবিংশ শতকের শুরুতে নরওয়ে তার ভাষার অধিকার নিয়ে পৃথক হয়ে গেলেও, আয়ারল্যান্ড পারেনি। এখনও ইংরাজিই সেখানকার সরকারি ভাষা।
আর বিশ্বজুড়ে ভাষা আন্দোলনের কথা বলতে গেলে আমাদের আরেক প্রতিবেশী দেশ নেপালের কথাই বা ভুলি কী করে? ১৯০৬ সালে শাহ রানার রাজত্বকালে বেআইনি ঘোষণা করা হয় নেপাল ভাষাকে। শুধু সরকারি কাজেই নয়, দুজন মানুষ তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতেও পারবে না। এমনই ছিল ডিক্রি। তবুও নিজেদের মাতৃভাষাকে আঁকড়ে ধরে থেকেছেন তাঁরা। নেপাল ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। ১৯২৮ সালে এই ভাষার ব্যাকরণ লেখেন সুকুরা রাজ। নেপাল ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ তিনি। এরপর একের পর এক লেখককে গ্রেপ্তার করা হয়। জেলের মধ্যে প্রবল অত্যাচার সহ্য করেও ভাষার টান তাঁরা ভুলতে পারেননি। এই টান যে আসলে নাড়ির টান। তাই একটা শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়ার পরও এখনও সেই আন্দোলনের স্রোত বয়ে চলেছে। ১৯৯৯ সালে ১ জুন, নেপাল ভাষাকে বেআইনি ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। প্রতি বছর সেই দিন দেশজুড়ে পালিত হয় 'কালা দিবস'।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে এরকম আরো কত ঘটনা। ভাষাকে অক্ষ করে জোট বেঁধেছে মানুষ। সেই লড়াই কোথাও সফল হয়েছে, কোথাও হয়নি। কিন্তু মানুষকে তার নিজস্ব পরিচয় শিখিয়ে দিতে পেরেছে। বিশ্বায়িত পৃথিবীতেও মানুষ যে শিকড়হীন নয়, এইসব লড়াই সেকথাই প্রমাণ করে। তাই অনেক জয়-পরাজয়ের চড়াই উৎরাই পেরিয়েও প্রত্যয় থেকে যায়, "অবশেষে বহুদূরে দিগন্তের দিকচিহ্ন মুছে দিয়ে ডাক দেবে আমরাই জয়ী!"
Powered by Froala Editor