“প্রতিদিন বিকালে কিছু না কিছু ঘটে এই ঘাটে। প্রত্যেকের জীবনের একটা করে গল্প থাকে। সবকিছু দূর থেকে দেখতে বেশ ভালো লাগে। দোকানটা অজুহাত। আসলে এই জীবনটা ছেড়ে যেতে পারি না।” একমনে কথাগুলো বলছিলেন লালুদা। গঙ্গার হাওয়ায় তখন কাশী মিত্র ঘাটের পরিবেশটা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গঙ্গার ঘাটে বসে হাওয়া খেয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন এবার উঠতে হবে। তবে মনটা এখনও ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এইসময় একটু চা পেলে বাঙালির মন্দ লাগবে না। কিন্তু কলকাতার রাস্তায় চা মানেই তো হয় দুধ চিনি মিশিয়ে এক সরবৎ। অথবা নুন লেবু দিয়ে একটা পানীয় কিছু। তবে গঙ্গার ঘাটে একটু খুঁজলেই আপনি পেয়ে যেতে পারেন এক কাপ দার্জিলিং লিকারও। বিশ্বাস না হলে চলুন কাশী মিত্র ঘাটে। সেখানে রেললাইনের ধারে সারি সারি দোকানের মধ্যে লালুদার চায়ের দোকান আলাদা করে খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না। যে কেউ দেখিয়ে দেবেন।
না, কোনো ঝলমলে ক্যাফে নয়। রাস্তার ভিড়ের মধ্যে যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়েও মানুষের গায়ে গা ঠেকে যাচ্ছে, সেখানে দাঁড়িয়েই দার্জিলিং লিকারের স্বাদ নিতে পারেন। গত ৫ বছর ধরে ঘাটে বেড়াতে আসা মানুষের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তাও যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে ব্যবসাও। “আসলে আমি নিজে কলেজে পড়ার সময় ঘাটে এসে বসে থাকতাম। দেখতাম ঘাটের পাশের দোকানে বহু মানুষের ভিড় হলেও আমাদের বয়সি ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে খুব কম। তখনই মনে হয়েছিল একটা কিছুর অভাব আছে।” বলছিলেন প্রশান্ত পাল ওরফে লালুদা। সেই অভাব পূরণ করতেই চায়ের দোকান খুলে বসলেন শেষ পর্যন্ত।
কথায় কথায় উঠে আসছিল তাঁর জীবনের কথাও। ছোটো থেকে শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি মিলল না। তাই বাধ্য হয়েই ব্যবসায় নেমেছেন। তবে এর জন্য কোনো আক্ষেপ নেই, জানালেন তিনি। “কোনো কাজ ছোটো বা বড়ো নয়।” বরং নিজের বয়সী বা সামান্য ছোটো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সমস্ত বিকালটা কাটিয়ে দিতে যেন তাঁর ভালোই লাগে। “এই আত্মীয়তার সম্পর্কটাই তো আমার দোকানটাকে আলাদা করে রেখেছে।” প্রশান্ত পাল বলছিলেন, “আর পাঁচটা চায়ের দোকানে ভিড়ের মধ্যে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কটা গজিয়ে ওঠে না। কিন্তু আমার দোকানে যাঁরা একবার এসেছেন, তাঁরা আবারও আসবেন।”
আরও পড়ুন
বাড়ির গরুর দুধ দিয়েই তৈরি চা, আহিরীটোলা ঘাটে আড্ডাপ্রেমীদের নিশ্চিত ঠিকানা সাধুবাবার দোকান
চায়ের সঙ্গে পেয়ে যাবেন বাটারটোস্ট বা ঘুগনিও। লালুদার ইচ্ছে হলে কোনোদিন দুপুরের দিকে রুটি মাংসও পেয়ে যেতে পারেন। যেদিন ঘাটে যেমন মানুষ আসেন, সেদিনের আয়োজনও সেরকম হয়। কারোর আতিথ্যে যেন একটুও খুঁত না থাকে, সেদিকে সবসময় নজর দিয়ে চলেছেন তিনি। এভাবেই তো পড়ন্ত বিকালের গল্পগুলো ধরে রাখছেন তাঁর দোকানে।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
১৭৫ বছরের পুরনো মিষ্টির দোকান, সেখানেই তৈরি বিশ্বের প্রথম রসগোল্লা তৈরির যন্ত্র