সবুজের কোলে শিশুদের একটুকরো ‘খেলাঘর’ লক্ষ্মীকান্তপুরে

‘বিগত কয়েকবছর ধরে দেখতে পাচ্ছি, পল্লীগ্রামেও থাবা বসাচ্ছে শহর। পল্লীপ্রকৃতির কোলে বাসা বাঁধছে ইট-কাঠ-কংক্রিট। ফলে আমাদের ছেলেবেলাগুলো থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ।’

বলছিলেন ‘খেলাঘরে’র (Khelaghar) কর্মী সৌমিক ঘোষ। পাশেই অশোক, আকাশমণির জঙ্গল। অত্যাধুনিক মিয়াওয়াকি পদ্ধতিতে চলছে সবুজায়ন। সদ্য জল ছড়ানো কাদামাটি মেশা সবজিখেত। লক্ষ্মীকান্তপুর (Lakshmikantapur) থেকে টোটোয় ঠিক পনেরো মিনিটে ভগবতীপুর। সেখানেই বিঘে আটেক জমির উপরে চলছে বিরাট কর্মযজ্ঞ। এক ‘সব পেয়েছির ইস্কুল’। নাম খেলাঘর। লক্ষ্মীকান্তপুর এলাকার প্রায় ৯০টি গ্রামের প্রায় ৮০০ জন শিশু খেলাঘরের পড়ুয়া। রয়েছেন ১৮ জন শিক্ষিকা। ছাত্রছাত্রীদের বাৎসরিক মাইনে সামান্যই। লোয়ার কেজি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত চলে পাঠদান। রয়েছে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থাও। তবে ‘খেলাঘর’ আর পাঁচটা ইস্কুলের চেয়ে বেশ খানিক আলাদা।

‘আমাদের মূল ভাবনাই হল আসলে শিশুমনের সঙ্গে সবুজের সংযোগ ঘটানো। আমরা চাই, পুঁথিগত পরিবেশ বিজ্ঞানের বেড়াজালে ওদের আটকে না রেখে, অন্তত প্রকৃতিপাঠের অক্ষর পরিচয়টুকু করিয়ে রাখতে। ওদের ছেলেবেলা জড়িয়ে থাকুক অশোক, দেবদারু। আর সেই উপলক্ষেই গত সাত দিন জুড়ে চলছে চলছে অরণ্য সপ্তাহ পালন।'

আরও পড়ুন
স্কুলছুট তরুণের উদ্যোগেই 'প্রাণে' বাঁচছে ঐতিহ্যবাহী সেতু!

খানিক দূরেই বাসন্তী শাড়ি, আর রংবেরঙের পাঞ্জাবিতে ফুলের দল। কেউ লোয়ার নার্সারি, কেউ বা ক্লাস থ্রিতে পড়ে। তাদের মধ্যে একজন বুক ফুলিয়ে জাহির করল, ‘অঙ্কটা খুব টাফ। বিজ্ঞান অনেক ভালো।' আরেকজন বিজ্ঞের মতো মুখে জানান দিল, ইতিহাস তার প্রিয় বিষয়। ইতিহাসের কোন জায়গাটা ভালো লাগে জিজ্ঞাসা করায় গম্ভীর গলায় উত্তর এল, ‘প্রস্তর যুগ।' একটু পরেই রাস্তায় সারি বেঁধে চলতে শুরু করল, কচিকাঁচার দঙ্গল। সামনের দিকে শাড়ি আর ফুলের সাজে সেজেছে মেয়েরা। পেছনে চতুর্দোলা কাঁধে চলেছেন, বছর আটের চারজন তল্পিবাহক। নেপথ্যে বেজে উঠছে, ‘মরুবিজয়ের কেতনও ওড়াও…’  নাচের ছন্দে পা পড়ছে শিশুদের। গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহ তাদের উৎসাহে কিছুমাত্র ভাঁটা ফেলছে না।

আরও পড়ুন
৫৭ বছর বয়সে স্বপ্নপূরণ, সরকারি স্কুল শিক্ষক হলেন অন্ধ্রের ব্যক্তি!

 

আরও পড়ুন
স্কুলবেলা থেকেই সিনেমার জন্য লড়াই, ‘এশিয়ান’-এ স্থান পেলেন বাঙালি পরিচালক

হাঁটতে হাঁটতে সৌমিক বলে চলেন, ‘মূলত তিনটি জায়গায় গড়ে উঠেছে খেলাঘর। বছর কুড়ি আগে শুরু হয়েছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কুলপী ব্লকের রঘুনাথপুরে। তারপর এই লক্ষ্মীকান্তপুর সংলগ্ন ভগবতীপুর। এছাড়াও জয়নগরেও রয়েছে খেলাঘরের আরো একটি ইস্কুল।’ প্রতিবছর জুলাই মাসে একটি নিৰ্দিষ্ট থিম মেনে হয় অরণ্য সপ্তাহ উদযাপন। এইবছরের থিম— ‘বিশ্বভরা প্রাণ’। ১৩ থেকে ২০ জুলাই ধরে এই থিম মেনেই চলছে নানাবিধ অনুষ্ঠান। উদযাপনের অংশ হিসাবে থাকে থিম অনুযায়ী অভিনব পোশাক পরিধান, এবং প্লাস্টিক বিরোধী প্রচারমূলক নানা পদক্ষেপ। যেমন গত দুদিন ধরে ছেলেমেয়েরা লক্ষ্মীকান্তপুর স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চলে স্থানীয় মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে প্ল্যাস্টিক বর্জনের বার্তা। এবারের থিম অনুযায়ী ‘যেমন খুশি সাজো'তে, কেউ সেজেছে কমলালেবু, কেউ বা তরমুজ। তবে অরণ্য সপ্তাহ উদযাপনের প্রধান আকর্ষণ এই মিছিল— ‘ডান্স আ্যন্ড প্ল্যান্টেশন’। যেটি অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের বৃক্ষরোপণের আদলে। আশি-নব্বইজন কচিকাঁচা প্রায় নাচের তালে তালে দু-কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ভগবতীপুর সংলগ্ন একটি জমিতে বৃক্ষরোপণ করে। চতুর্দোলায় থাকে গাছের চারা। সেই চারা পোঁতার পর ছাত্রছাত্রীরা পঞ্চভূতের শপথ নেয়। গতকাল ২০ জুলাই, সেই মিছিলেই সামিল হলাম আমি। 


আমাদের মিছিল পৌঁছল একটি ছোট্ট মন্দির সংলগ্ন জমিতে। হাসিমুখে শিশুদের আহ্বান করলেন প্রৌঢ় সেবাইত। আশেপাশে জড়ো হলেন গ্রামবাসীরা। তাঁদের মুখও আলোয় উদ্ভাসিত। নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হল বৃক্ষরোপণ। তারপর ছোট্ট একটি নৃত্যপ্রদর্শনী। এবং সেই রাস্তা ধরেই আবার ফেরা। 

ইস্কুলের আপিসঘরে বসে কথা হচ্ছিল প্রধান শিক্ষিকা মৌমিতা দে-র সঙ্গে। মৌমিতা বলছিলেন, এই অরণ্য সপ্তাহ ঘিরে পড়ুয়াদের উৎসাহের কথা। ‘ক্লাসে যখনই জিজ্ঞাসা করি, গাছ কাটা উচিত? সবাই সমস্বরে বলে, আরো গাছ পুঁততে চাই ম্যাম। আমাদের জমিতে অধিকাংশ গাছ নিজে হাতে লাগিয়েছে ছাত্রছাত্রীরা। এমনকি প্ল্যাস্টিক বিরোধী মিছিলে ওরাই হাঁক দিয়ে গ্রামবাসীদের সচেতনতার বার্তা ছড়াচ্ছিল। আর এই অনুষ্ঠান ঘিরে ওদের উত্তেজনার শেষ নেই। সকলে নিজে থেকে এসে নাম দিয়ে যায়।’

 

প্রাথমিক শিক্ষার পরিসরে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে খেলাঘর। এখানে চামচে করে পাঠ্যপুস্তক গিলিয়ে দেওয়ায় বিশ্বাসী নন শিক্ষিকারা। এখানে শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি অত্যাধুনিক। রয়েছে স্মার্ট ক্লাসের ব্যবস্থাও। মৌমিতা বলছিলেন, ‘আমরা কেবল চাই ওদের প্রশ্ন করার বোধকে চাগিয়ে তুলতে। এবং প্রকৃতিপাঠের এই বীজটি ওদের মনে সারাজীবনের জন্য বুনে দিতে। যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মেরও গায়ে লাগে সবুজের ছোঁয়া।’

তবে এত বড়ো একটি কর্মযজ্ঞ চালানোর জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। কলকাতায় ‘খেলাঘর' কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করেন দুটি বেসরকারি ইস্কুল। সেই ইস্কুলগুলি থেকে আয়ের প্রায় সবটুকুই ব্যয় হয় এখানেই। এছাড়া ছোট্ট সবজিখেতের ফসলই ওঠে খেলাঘর ক্যান্টিনের থালায়। সবমিলিয়ে আপাদমস্তক স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি উদ্যোগ হয়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা। ভবিষ্যতে আরো অনেক ‘খেলাঘর' গড়ে তোলার সংকল্প নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। প্রকৃতিবিরোধী সভ্যতার সর্বগ্রাসী হুঙ্কারের বিরুদ্ধে এ যেন একটুকরো সবুজ সংকেত।

Powered by Froala Editor