গ্রামবাংলা ভারতীয় উপমহাদেশের এক বিপন্ন বিস্ময়। সেখানে ধর্মের নামে ভেদাভেদ, হানাহানির পাশাপাশি দেখা যায় অদ্ভুত সব ঐক্য। তাই হয়তো হিন্দুর সত্যনারায়ণ মুসলমান গৃহস্থের পূজা পান ‘সত্যপীর’ রূপে। হিন্দুদের বনদেবী মুসলমানদের কাছে হয়ে যান বনবিবি। আবার অনেকসময় এই ভেদ থাকেও না। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সত্যপীরের সিন্নি খান, ঘোড়া বাঁধেন বনবিবির থানে। আর এভাবে চলতে চলতেই, একদিন হঠাৎ শহুরে সমাজ জেনে ফেলে গ্রামবাংলার অপেক্ষাকৃত দুর্লভ এক মিলনের কথাও। হিন্দুর ঘরের লক্ষ্মীদেবী মুসলমানদের কাছে ঠাঁই পেয়েছেন ‘লক্ষ্মীবিবি’-র পরিচয়ে। পাঁচালি পড়া হচ্ছে, পালন করা হচ্ছে ব্রতও।
কিন্তু হঠাৎ লক্ষ্মীকে কেন আপন করে নিল গ্রামবাংলার মুসলমান সমাজের একাংশ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বসলে, জানা যায় আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা। ইতিহাস বলে, বাংলার বেশিরভাগ মুসলমানরাই একসময় হিন্দু বা বৌদ্ধ ছিলেন। ত্রয়োদশ বা চতুর্দশ শতাব্দীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পরেও, পুরনো আচার বা অভ্যাসগুলিকে ছাড়তে পারেননি তাঁরা। ফলে ধর্ম পাল্টে গেলেও, লক্ষ্মীকে সঙ্গেই রেখে দিয়েছেন কেউ কেউ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। ঠিক যেভাবে হিন্দু বিবাহের অনেক আচার দেখা যায় গ্রামীণ মুসলমান সমাজে, তেমনই বিভিন্ন হিন্দু দেবদেবীও খানিক ভোল পাল্টে অনায়াসে আশ্রয় নিয়েছেন মুসলমানের কুটিরে। ফলে, সম্পদের দেবী লক্ষ্মী তাঁদের কাছে হয়ে যান ‘লক্ষ্মীবিবি’।
শুধু তাই নয়, শিরনীও মানত করা হয় বিবির উদ্দেশ্যে। উপকরণ হিসেবে থাকে চিতইপিঠা, মিষ্টি, চিনি, কলা, দুর্বা, সিঁদুর। বাড়ির মেয়েরা ভাঁড়ার গোলার ওপরে কলাপাতায় পাঁচ জোড়া পিঠা রাখেন। গোলার নিচেও পাঁচ জোড়া। এরপর ডাক পড়ে মোল্লার। ফাতেহা পড়ে পালন করা হয় শিরনী উৎসব। তারপর প্রসাদ হিসেবে সকলে ভাগ করে খায় গোলার নিচে রাখা পিঠাগুলি। ওপরের পিঠা আরও কিছুদিন রাখা থাকে, বনবিবির ভোগ হিসেবে।
কিন্তু কখন হয় এই লোকাচার? প্রত্যেক সপ্তাহে বৃহস্পতিবার এই আচার পালন করার সামর্থ্য তো গরিব মুসলমানের নেই! অনেকেই বছরে যে-কোনো একটি বৃহস্পতিবার বেছে নেন। মূলত যে মাসে নতুন ধান ঘরে আসে, সেই মাসেরই কোনো এক বৃহস্পতিবারে পূজা পান লক্ষ্মীবিবি। আউস ধান এলে শ্রাবণ মাসে, আমন এলে অগ্রহায়ণ মাসে আর বোরো এলে বৈশাখ মাসে পালন করা হয় শিরনী উৎসব। এই উপলক্ষে গ্রামের রাখাল বালকেরাও বাড়ি-বাড়ি যায়, মাগন গান(এটি লোকগানের একটি ধারা। কোনো ব্রত-পার্বণ উপলক্ষে গ্রামের কিশোররা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে দেবদেবী বা পীরের নামে স্তুতি গেয়ে চাল-ডাল ও টাকাপয়সা সংগ্রহ করে। ‘মাগন’ শব্দের অর্থ ‘চাওয়া’।) গেয়ে সংগ্রহ করে চাল ডাল। মাগনের জন্য গাওয়া হয় –
"আইলামরে অবণে লক্ষ্মীবিবির চরণে।
লক্ষ্মীবিবি দিলা বর, চাইল কড়ি বাইর কর।।"
এ তো গেল লক্ষ্মীবিবির কথা। এছাড়াও অনেক মুসলমান ফকির লক্ষ্মীর পাঁচালি গেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে জীবিকা নির্বাহ করেন। অন্তত করতেন, আজ থেকে বেশ কয়েক দশক আগেও। তাঁদের পূর্বপুরুষরা যখন হিন্দু ছিলেন, তাঁদের জীবিকা ছিল লক্ষ্মীর পাঁচালি গেয়ে চাল-ডাল ও অর্থ সংগ্রহ করা। ধর্ম বদলে গেলেও, বংশপরম্পরায় বদল হয়নি জীবিকার।
আরও পড়ুন
মহানায়কের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো; ৭০ বছর ধরে একই পরিবারের হাতে তৈরি প্রতিমা
দীনেশচন্দ্র সেন ১৯২১ সালে প্রকাশিত ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ বইয়ে লিখেছিলেন – ‘এখনও পূর্ববঙ্গের এক শ্রেণীর মুসলমানেরা লক্ষ্মীর পাঁচালী গাহিয়া জীবিকা অর্জন করিয়া থাকে। ‘প্রাতঃকালে ছড়া দেয় রে সাঁঝ হৈলে বাতি। লক্ষ্মী বলে সেই ঘরে আমার বসতি।’ ‘সতী নারীর পতি যেন পর্ব্বতের চূড়া। অসতীর পতি যেমন ভাঙ্গা নায়ের গুঢ়া।’ প্রভৃতি গান অনেকেই মুসলমান ফকিরের মুখে শুনিয়া থাকিবেন। এই ছড়াগুলিতে অনেক স্থানে খুব প্রাচীন ভাষার নিদর্শন আছে। ইহা কখনই সম্ভবপর নহে যে মুসলমান ধর্ম্ম পরিগ্রহের পর এই সকল ফকিরেরা লক্ষ্মীর পাঁচালী শিখিয়াছিল। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম্মাবলম্বী থাকার সময় যাঁহারা এই পাঁচালী গাইয়া জীবিকা অর্জন করিত, তাহাদেরই বংশধরগণ সেই বৃত্তি এখনও অব্যাহত রাখিয়াছে।’ যদি মনে করেন সেই পরম্পরা আর বেশিদিন ছিল না, ভুল করবেন। কেননা ১৯৬৫ সালে ডক্টর ওয়াকিল আহমেদের লেখা ‘বাংলার লোক-সংস্কৃতি’ বইয়েও উল্লেখ পাওয়া যায় এইসব ফকিরের, যাঁরা লক্ষ্মীর পাঁচালি গেয়ে ভিক্ষা করেন।
তারপর কেটে গেছে আরও পঞ্চাশ বছর। গ্রামবাংলার এই জীবিকা কি এখনও টিকে আছে? সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে মুসলমানরা কি লক্ষ্মীর পাঁচালিকে ত্যাগ করেছেন? অথচ এখনও তো বর্ধমানের গ্রামাঞ্চলে খোঁজ পাওয়া যায় এমন এক লক্ষ্মীর পাঁচালির, যা জনৈক মুসলমান ফকিরের লেখা -
"কৃষ্ণবর্ণ কেশ আর সত্য কথা কয়।
তার গৃহে মোর সদা মন রয়।।
সন্ধ্যাকালে সন্ধ্যা দেয় শুচি বস্ত্র হৈয়া।
সেই নারী গৃহে আমি থাকি যে বসিয়া।।
প্রতি গুরুবারে যেবা মোরে পূজা করে।
তার গৃহ নাহি ছাড়ি তিলেকের তরে।।"
আরও পড়ুন
মুঠপুজো - গ্রামবাংলার যে আদিম লক্ষ্মী-আরাধনায় শুরু হয় নবান্নের মাস
গ্রামবাংলার আড়ালে-আড়ালে এখনও অভয়মুদ্রা ঘুরে বেড়ায় লক্ষ্মীবিবির। সেখানে তাঁকে বামে নিয়ে নারায়ণও থাকেন। তিনি পয়গম্বর। বিবির সোয়ামী তিনি। সত্যনারায়ণ যখন সত্যপীর হলেন, চট্টগ্রাম থেকে পাওয়া একটি পুঁথিতে দেখা গেল –
"প্রণমোহ সত্যপীর পরম কারণ।
তান নাম লৈলে নরে তরিব শমন।।
সত্যপীর হজরত পীর বুজুরুআ।
মুছলমানে ত জন্ম প্রভু ছিন্নি লাগিআ।।"
এভাবেই মিলে যায় সব। দেবদেবীরা নিজেদের মানিয়ে নেন হিন্দু-মুসলমান উভয়ের সঙ্গেই। মানিয়ে নেয় মানুষও। একসঙ্গে থাকে। থাকতে ভালোবাসে। কেননা লক্ষ্মীবিবি কৃপা করলে একা হিন্দুর ঘরে নয়, মুসলমানের ঘরেও ফসল উঠবে। ভালোমন্দ দুটো খেতে পাবে গেরস্ত। সুখে শান্তিতে দিন কেটে গেলে, কে আর ভাবতে চায় ধর্মের কড়াকড়ি নিয়ে!
আরও পড়ুন
লক্ষ্মীর কাছে ভেদ নেই ধর্মের, হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে পুজো করেন বর্ধমানের এই গ্রামে
Powered by Froala Editor