দুর্গাপুজোর দিনগুলি কেটে গেলে কেমন একটা শূন্যতা তৈরি হয় বাঙালির মনে। নিঝুম সন্ধ্যায় অফিস ফেরার ক্লান্তিতে অন্ধকার ফাঁকা পূজামণ্ডপগুলি যেন আরো বাড়িয়ে দেয় বিষাদ। হিমেল হাওয়ার মৃদু তীব্রতায় স্মৃতিতে ভিড় করে কয়েকদিনের আগের ফেলে আসা মুহূর্তরা। ভালো কাটুক বা মন্দ, দুর্গাপুজোর অনুভূতি আলাদা এক স্নেহের পরশে জড়িয়ে থাকে জীবনে। আবার সেই একটা বছরের অপেক্ষা। ততদিনের জন্য ফিরে যাওয়া রোজকার জীবনে। আর দিন গুনতে থাকা পরের বছরের জন্য।
তবে হাওড়ার জয়পুরের খালনা (Khalna) গ্রামের চিত্রটা এরকম নয়। বিজয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন করে সেজে ওঠে এই গ্রাম। কারণ, এখানের সবচেয়ে বড়ো উৎসব লক্ষ্মীপুজো। আকাশে কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ যখন বাংলার ঘরে ঘরে আহ্বান জানায় দেবী লক্ষ্মীকে, তখন হাজারো মানুষের সমারোহে পূর্ণ হয়ে ওঠে খালনা। দেবী এখানে ‘সর্বজনীন’। ছোটো বড়ো মিলিয়ে একশোটির কাছাকাছি পুজোর আয়োজন হয়ে এখানে প্রতিবছর। যে কারণে এর নামই হয়ে গেছে ‘লক্ষ্মীগ্রাম’। বাগনান রেল স্টেশন থেকে মাত্র ১৯ কিলোমিটার দূরের খালনা গ্রামের বিরাট বিরাট পূজামণ্ডপে দেবী লক্ষ্মী অধিষ্ঠান করেন তিনদিনের উৎসবে।
শোনা যায়, অন্তত দুশো বছর আগে এই অঞ্চলের কৃষকরা প্রতিবছর মুখোমুখি হত ভয়াবহ বন্যার। নদীর জল দুকূল ভাসিয়ে নষ্ট করে দিত সমস্ত ফসল। উপায়ের খোঁজে তারা প্রার্থনা জানায় দেবী লক্ষ্মীর কাছে। শুরু হয় চারুময়ী লক্ষ্মীর আরাধনা। ক্রমে কৃষিকাজের বদলে তারা মনোনিবেশ করল ব্যবসা-বাণিজ্যে। আর সেই থেকেই দেবী লক্ষ্মী যেন ‘অচলা’ হয়ে রইলেন খালনাতে। সোনা, লোহা ও অন্যান্য ধাতুর ব্যবসায় সমৃদ্ধি এসেছে গ্রামজুড়ে। বণিক সম্প্রদায়ের সেই পুজোই এখন পরিণতি হয়েছে সর্বজনীনে। দুর্গাপুজো ও কালীপুজোর সংখ্যা হাতে গোনা, লক্ষ্মীপুজোই এই গ্রামের প্রাণভোমরা।
দশমীর পর থেকেই সাজো সাজো রব পড়ে যায় খালনাতে। তুমুল ব্যস্ততা চোখে পড়ে সব জায়গায়। কর্মসূত্রে বাইরে থাকা গ্রামবাসীরা ফিরে আসেন ঘরে। দূরদূরান্ত থেকে কয়েক হাজার মানুষের আগমন ঘটে প্রত্যেকদিন। সারা রাত ধরে চলে পুজোপরিক্রমা। উৎসব প্রাঙ্গণের মেলাগুলিও ভরে ওঠে জনসমাগমে। ক্ষুদিরায় তলা, কৃষ্ণরায় তলার মতো বেশ কিছু পুজো পার করেছে দেড়শো বছর। ঐতিহ্যময় সাবেকি পুজো তো আছেই, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুরু হয়েছে ‘থিম’ পুজোও। যা অনায়াসে টেক্কা দিতে পারে রাজ্যের বিভিন্ন দুর্গাপুজোর মণ্ডপকেও। এ বছর কোথাও জঙ্গল বুক, কোথাও চন্দ্রযান, কোথাও বা তুঙ্গনাথ মন্দিরের আদলে সেজে উঠছে পূজামণ্ডপ। আবার পরিবেশ সচেতনতামূলক থিমও চোখে পড়বে কোনো কোনো পুজোয়। সব মিলিয়ে অভিনবত্বের আস্বাদ ছড়িয়ে আছে গ্রামের প্রায় সর্বত্র।
আরও পড়ুন
লক্ষ্মী শুধুই চঞ্চলা নন, স্বয়ংসম্পূর্ণাও
দুর্গাপুজো নিয়ে সব বাঙালিরই আলাদা উন্মাদনা আছে অবশ্যই। তবে বিশেষ কিছু জায়গায় মহাসমারোহে পালিত হয় অন্য পুজোও। যেমন কালনার সরস্বতী পুজো, বাঁশবেড়িয়ার কার্তিক পুজো কিংবা চন্দননগর-কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো। এই উৎসবগুলি ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে অনেক বেশি আপন, শিকড়ের বড়ো কাছাকাছি। খালনার লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গেও জড়িয়ে থাকে একই রকম আবেগ। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের সার্থক উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া এই পুজোগুলির সঙ্গে।
আরও পড়ুন
কালীপুজোর দিনই আরাধনা করা হয় লক্ষ্মীর ‘দিদি’ অলক্ষ্মীকে; কিন্তু কেন?
চিত্রঋণ : খালনা লক্ষ্মীপূজা ফেসবুক পেজ
Powered by Froala Editor