গ্রামের এক প্রান্তে মাটির দাওয়ায় বসে এক মনে সরু বাঁশের কাঠির সঙ্গে ধানের শীষ বা ছড়া বেঁধে চলেছে স্বামী-স্ত্রী অথবা বাবা-মেয়ে, এই দৃশ্য একদমই খুব একটা অচেনা নয় উড়িষ্যার নুয়াপদা অঞ্চলে। এই ধানের ছড়া বেঁধে বেঁধে তৈরি হবে শস্যের দেবী, ফলনের দেবী লক্ষ্মী ঠাকুরের প্রতিমা। জীবন এমনই সরল এখানে। গঙ্গা পুজোর জন্য যেমন বেছে নেওয়া গঙ্গার জল। দেবীও এতটাই মানবিক।
গ্রামের পথে চলতে চলতে হঠাৎ মন কেড়ে নিতে পারে অদ্ভুত এক বাজনার সুর। লক্ষীমায়ের পদ গেয়ে চলেছেন কোনো গ্রামীণ কবি। কোথা থেকে শিখলেন তাঁরা এই গান? জিজ্ঞেস করলে লাজুক মুখে উত্তর আসবে, পূর্বপুরুষদের থেকেই শ্রুতির মাধ্যমে এই অপার্থিব শিল্প মননে ধারণ করেছেন তাঁরা সকলেই। সুতোয় বাধা তালপাতার পুঁথির একের পরে এক পাতা জুড়ে লেখা আছে পনেরো শতকের কবি বলরাম দাসের রচিত ‘লক্ষী পুরাণ কাব্য’। সেই তালপাতার পুঁথি থেকেই গান গেয়ে চলেছেন গ্রামীণ কবি। একটি তারের যে যন্ত্রটি সঙ্গত দিচ্ছে কবিকে, তার নাম 'লক্ষী বীণা' বা 'ব্রহ্ম বীণা'। প্রায় তিন ফুট লম্বা বাদ্যযন্ত্রটি তৈরি হয়েছে লাউখোলা এবং বাঁশ দিয়ে।
উড়িষ্যার নুয়াপদা জেলার খুদপেজা গ্রামে গেলে দেখা মিলবে এই সম্প্রদায়ের, যাঁরা এখনও বয়ে নিয়ে চলেছেন ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সুদীর্ঘ কয়েক পুরুষ ধরে এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছেন এই ‘দেবগুরু’ বা ‘দেবগুনিয়া’ সম্প্রদায়ের মানুষেরা। মূলত এই লক্ষী পুরাণ গাইতে গাইতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মাধুকরী সংগ্রহ করাই ছিল এই সম্প্রদায়ের প্রধান উপজীব্য। পরবর্তীতে তার সঙ্গেই যুক্ত হয় শস্য কণা দিয়ে লক্ষ্মী প্রতিমা গঠন। শুধু লক্ষ্মী প্রতিমাই নয়, পড়াশোনা না জানা গ্রামের শিল্পীরা অসাধারণ হাতের জাদুতে তৈরি করে ফেলেন ধানের কণা দিয়ে দেবর লক্ষ্মীর জন্য পালঙ্ক, রথ, কলস এবং এরকমই আরও অনেক কিছুই। এই শিল্প কলার নাম ‘ধান-কলা’ অথবা ‘ধান-লক্ষী’। সঙ্গীতের মতোই, এই হস্তশিল্পের ঐতিহ্যও পূর্বপুরুষদের থেকেই প্রবাহিত হয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
ছিমছাম মেঠো পথে দেখা মিলতে পারে গ্রামীণ কবিদের সঙ্গে; লক্ষী পুরাণ গেয়ে শোনাচ্ছেন গ্রামের মানুষদের কাছে। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলে একটি সম্পূর্ণ পাঠ। যদিও মার্গশিরা মাস, অর্থাৎ ইংরেজি ক্যালেন্ডার মতে নভেম্বর-ডিসেম্বরে একেকটি পাঠের সময়সীমা পার হয়ে যায় চার থেকে পাঁচ ঘণ্টাও। সাধারণত বাড়ির মহিলারাই মূল শ্রোতা। দেবগুরুরা তাঁদের পাঠ করে শোনান কী করে রাখতে হবে নানান ব্রত অথবা উপবাস পালনের রীতি-বিধি। বদলে তারা পান ভেট স্বরূপ ধান বা চাল অথবা কখনও কখনও ‘ধান-কলা’র লক্ষ্মী প্রতিমার বিনিময়ে ৫০ বা ১০০ টাকা। যদিও অর্থের দাবি থাকে না কোনও।
প্রাচীনকালে নিচু জাতের হিন্দু পরিবারদের থেকে দেবগুরুদের আমন্ত্রণ জানানো হত তাঁদের বাড়িতে এসে লক্ষী পুরাণ গেয়ে শোনানোর জন্য। উঁচু জাতের মহিলাদের মার্গশিরা মাসে লক্ষ্মী প্রতিমার প্রয়োজন হলে, সন্ধান পড়ত দেবগুরুদের। পরবর্তীতে দলিত এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেও দেবগুরুদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। লক্ষী পুরাণ মূলত অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে কথা বলার জন্যই এই গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে কোনও কোনও মহলের ধারণা।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির সর্বগ্রাসী হাঁ যেন ক্রমাগত গিলে ফেলছে এই ঐতিহ্যকেও। দেবগুরু সম্প্রদায়ের ৪০টি পরিবারের অনেকেই বর্তমানে ইটভাটায় কাজ করতে যান পেটের টানে। ক্রমাগত ফিকে হতে শুরু করেছে এই 'ধান-কলা'র সোনালী রং। অনেক পরিবারের সদস্যেরাই নাম লিখিয়েছেন মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ রোজগার যোজনা প্রকল্পে। মিড ডে মিলের টানে স্কুলে যেতে শুরু করেছে বাড়ির শিশুরাও। তবুও যে কোনও পরিবারের সদস্যদেরকে জিজ্ঞেস করলে মেঠো সহজ গলায় উত্তর আসে একটাই, ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা শিখুক। বড় হোক। কিন্তু দেবগুরু সম্প্রদায়ের নিজস্ব পরিচিতি এই ‘ধান-কলা’ এবং ‘লক্ষী পুরাণ’ যেন কোনোদিন না হারিয়ে যায় তাদের ভিতর থেকে।
আরও পড়ুন
মূর্তি নয়, পুজো হত পদচিহ্নেই; ধীরে ধীরে আলপনায় মিশে গেল লক্ষ্মীর পা
Powered by Froala Editor