১৯৬৮ সাল। ব্রাজিলে তখন চলছে সামরিক স্বৈরশাসন। সেসময় সেনাবাহিনীর যান চলাচলের জন্য উত্তরের মানাউস থেকে দক্ষিণ ব্রাজিলের পোর্তো ভেলহো পর্যন্ত দীর্ঘতম হাইওয়ে তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল তৎকালীন প্রশাসন। সব মিলিয়ে যার দৈর্ঘ্য প্রায় ন’শো কিলোমিটার। অর্থাৎ, প্যারিস থেকে বার্লিনের দূরত্বের সমান। তবে ১৯৮৮ সালে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সেই প্রকল্প। তারপর পরিত্যক্ত হয়েই পড়েছিল সেই সড়কপথ। বন্যায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল অধিকাংশ অংশ। ফলে নিজের মতো করেই আবার বেড়ে উঠেছিল প্রকৃতি। তবে দীর্ঘতম সেই রাস্তার নির্মাণ পুনরায় শুরু করলেন বলসোনারো প্রশাসন। আর তার জেরেই কাটা পড়তে চলেছে লক্ষ লক্ষ বৃক্ষ।
বিআর৩১৯। ফেডারাল সরকারের এই সড়ক নির্মাণের কারণেই বর্তমানে উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে বনভূমি নিধন। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে সাম্প্রতিক গবেষণায়। ব্রাজিলের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ স্পেসিয়াল রিসার্চ এবং কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা জানাচ্ছে, ২০১৯ সালের তুলনায় গত বছরে প্রায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে অরণ্যনিধনের পরিমাণ। শুধু ২০২০-র জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই ধ্বংস হয়েছে ১৬.৪ বর্গকিলোমিটার অরণ্য।
অবশ্য বছর কয়েক আগে থেকেই এই রাস্তার পুনর্নির্মাণ শুরু করেছিল ব্রাজিল প্রশাসন। সেই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত ছিল বিআর৩১৯ এর ‘এ’ ও ‘বি’ সেগমেন্ট। তাদের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ১৯৪ ও ১৬৪ কিলোমিটার। এই অংশগুলির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়েছিল সেই সত্তরের দশকেই। ফলত নতুন করে প্রয়োজন পড়েনি লাইসেন্সিং-এর। কাটা পড়ে হাজার হাজার গাছ। কিন্তু আইনত এই নির্মাণ বৈধ হওয়ায় প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারেননি পরিবেশবিদরা। চলতি বছরের শুরুতেই এই রাস্তার তৃতীয় অংশ তথা ‘সি’ বা ‘চার্লি’ সেগমেন্টের পুনর্সংস্করণ শুরু হয়। প্রশ্ন উঠতে শুরু করে তখনই। কারণ, এই অংশটির কোনো ভিত্তিপ্রস্তরই ছিল না।
একজোট হয়েই সেসময় প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন দেশের পরিবেশকর্মী ও গবেষকরা। প্রতিবাদের চাপে গত মার্চ মাসে বন্ধ করা হয় ‘চার্লি’ সেগমেন্টের কাজ। তিন মাস মামলা চলার পর সম্প্রতি ব্রাজিলের আদালত পুনরায় অনুমোদন দিল এই বিআর৩১৯-এর নির্মাণে। শুধু ‘চার্লি’-ই নয়, বরং গোটা মহাসড়কটি নির্মাণের ক্ষেত্রে আর কোনো বাধাই রইল না বলসোনারো প্রশাসনের ক্ষেত্রে।
আরও পড়ুন
উপড়ানো গাছ পুনর্বাসনের জন্য ‘কাঁধে’ তুলে নিলেন গ্রামবাসীরাই!
এই প্রকল্পের জন্য অসংখ্য গাছ কাটা পড়বে তো বটেই, পাশাপাশি চরম সমস্যায় পড়তে চলেছে প্রাচীন জনজাতি গোষ্ঠীগুলিও। আমাজনের মধ্যে দিয়ে বিস্তৃত এই রাস্তার জন্য বাসস্থান হারাতে চলেছেন বহু মানুষ। পাশাপাশি ইতিহাসের দোহাই দিয়ে পুনর্বাসন কিংবা ক্ষতিপূরণ হিসাবে বৃক্ষরোপণের কাজও যে এড়িয়ে যাবে ব্রাজিলের প্রশাসন রয়ে যাচ্ছে সেই সম্ভাবনাও। গবেষকদের অনুমান শুধু বিআর৩১৯ এর জন্য, দু’দশকের মধ্যে ব্রাজিলে কার্বন নির্গমণের মান গিয়ে পৌঁছাবে ৮০০ কোটি টনে। সেইসঙ্গে, রাস্তার নির্মাণ সম্পূর্ণ হলে ধীরে ধীরে গোটা অঞ্চলজুড়েই গড়ে উঠবে বিভিন্ন নির্মাণ, বাসস্থান। যার ফলস্বরূপ ২০৫০ সালের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ৯৮০০ বর্গকিলোমিটার অরণ্য।
আরও পড়ুন
গাছতলায় ‘মুঘল-এ-আজম’এর গান রেকর্ড; গানের পুস্তিকা লিখেছেন শার্লক হোমসও!
তবে এই সড়কপথই যে একমাত্র উত্তর ও দক্ষিণ ব্রাজিলের মধ্যে একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম, তেমনটা নয়। বরং গোটা অঞ্চলটার মধ্যে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে আমাজন এবং তার বিভিন্ন শাখানদী। গবেষকদের দাবি, বিকল্প হিসাবে সেই নদীপথে জোর দিলেই এই ক্ষতি এড়িয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু সে কথায় কান দিতে নারাজ বলসোনারো প্রশাসন…
আরও পড়ুন
দুই সহস্রাধিক গাছের অভিভাবক তিনি, বার্ধক্যও দমাতে পারেনি পুরুলিয়ার দুখু মাঝি-কে
Powered by Froala Editor