লাইকা একটি কুকুরের নাম। জীবন ছাপোষা। ঠিকানা কেয়ার অব ফুটপাথ। কে জানত, খুব দ্রুত সবকিছু বদলে যেতে চলেছে।
১৯৫০ সালের ঘটনা। আকাশের দিকে তাকিয়ে উৎসাহী মানুষের প্রশ্ন, কী আছে মহাবিশ্বে? অতল মহাশূন্যে? কত গভীর ওই চাঁদ? কত অগাধ মহাকাশ? প্রশ্নগুলির উত্তর জানতেই বিজ্ঞানের কল্যাণে রকেট তৈরি। কথা হল, মানুষ সেই রকেটের সওয়ারি হয়ে পৃথিবী দেখবে কিনা। মানুষ কিন্তু প্রথমে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বেছে নেয় এক কুকুরকে। একটি জীবের উপর মহাকাশে ওড়ার প্রভাব কী, সেটাই ঝালিয়ে নেওয়ার লক্ষ্য বিজ্ঞানীদের। ১৬২ দিন ২৫৭০ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণের পর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কাছাকাছি আসে সেই মহাকাশযান। কিন্তু লাইকা আর ফেরেনি।
সোভিয়েত রাশিয়া মহাকাশ প্রতিযোগিতার প্রথম খেলায় বাজি মারে। অসীম আকাশে সেই যাত্রাপথে রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে আসে আমেরিকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা গোপনে নাৎসি জার্মান বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী নিয়োগ করে। এর মধ্যে একজন ওয়ার্নার ফন ব্রাউন। ব্রাউনের হাতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় V2 নামে একটি উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি। ব্রাউনের এই প্রতিভার কারণেই আমেরিকা আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রোগ্রামের কমান্ড তাঁর হাতে তুলে দেয়। যদিও তখন রকেট আর মিসাইলের অর্থ একই। এভাবেই শুরু স্পেস প্রোগ্রামের শুরুর পর্ব। ব্রাউন নিজেও মহাকাশ কর্মসূচিতে খুব আগ্রহী ছিলেন। যুদ্ধের সময় যখন তাঁর ক্ষেপণাস্ত্র লন্ডনে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিল, ব্রাউন বলতেন, এই রকেটগুলো ঠিকমতো কাজ করছে কিন্তু তাদের অবতরণ হয়েছে ভুল গ্রহে। আসলে তখন রকেটগুলোকে দূর মহাকাশে পাঠানোর স্বপ্ন দেখছেন ব্রাউন
১৯৫৫ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ারের ঘোষণা করেন, আমেরিকা শীঘ্রই তার প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করবে। চার দিন পরে রাশিয়াও একই রকম ঘোষণা করে। দুই মহাশক্তিধর দেশই তখন মহাকাশ দৌড়ে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। আমেরিকা ইতিমধ্যেই প্রস্তুতিতে মগ্ন। কিন্তু রাশিয়াও তো আনাড়ি নয়। ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে প্রথম স্যাটেলাইট স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপণ তাদের। আমেরিকা প্রতিক্রিয়া জানানোর আগে স্পুটনিক-২ উৎক্ষেপণের প্রস্তুতিও সেড়ে ফেলে পূর্ব ইউরোপে। ৩০ দিনের মধ্যে এটি লঞ্চও করে। তবে স্পুটনিক ১ এবং ২-এর মধ্যে পার্থক্য ছিল। এবার এই স্যাটেলাইট একা নয়, একজন জলজ্যান্ত সঙ্গীও তার মহাকাশপথের দোসর। স্পুটনিক শব্দের অর্থ সহযাত্রী। এখান থেকেই মহাকাশের গল্পে সহযাত্রী লাইকার প্রবেশ।
আরও পড়ুন
মহাকাশ থেকে ‘খসে পড়া’ একমাত্র মানুষ, সোভিয়েত নভোচরকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল নাসাও
স্পেস রেসের চূড়ান্ত লক্ষ্য মানুষকে মহাকাশে পাঠানো। এ কারণেই আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়া প্রথম থেকেই পরীক্ষায় নিয়োজিত ছিল। মহাকাশ অভিযান মানবদেহে কী প্রভাব ফেলবে, তা জানতে প্রথমে প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা করা দরকার পড়ে। প্রথম রকেটের সাহায্যে পোকামাকড় ও শিম্পাঞ্জি মহাকাশে পাঠানো হয়। যদিও সেসব সাব-অরবিটাল মিশনের অংশ। অর্থাৎ তাদের মহাকাশে থাকতে হবে না, তাদের শুধু স্পর্শ করে ফিরে আসতে হবে। স্পুটনিক-১-এর সাফল্যের পর বোঝা যায়, স্যাটেলাইটটি মহাকাশে থাকতে পারে। মূলত এর পরই রাশিয়া তার পরবর্তী মিশনে একটি প্রাণী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক হয় পাঠানো হবে একটি কুকুর।
আরও পড়ুন
মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ‘চাঁদের টুকরো’!
মস্কোর শীত দুনিয়া প্রসিদ্ধ। শীতের শহরে পথ-কুকুররা ভবঘুরের মতো ঘুরঘুর করে। প্রচণ্ড ঠান্ডার সঙ্গে সয়ে গেছে তারা। এই কারণেই সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এই মিশনের জন্য কেবল এই জাতীয় বিপথগামী কুকুরই শ্রেয়। শতাধিক কুকুরের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হয় তিন। প্রশিক্ষণ শুরু হতেই বাদ পড়ে এক গর্ভবতী কুকুর। অবশেষে, এই মিশনের জন্য কুদরিয়াভকা নামে একটি মহিলা কুকুরকে বেছে নেওয়া হয়। মহিলা কুকুর বেছে নেওয়া হয়, কারণ পুরুষ কুকুর পা তুলে প্রস্রাব করে। ফলে মহাকাশযানের আকার বড় করতে হত। আকার বড় হলে মহাকাশযানের ওজন বেড়ে গিয়ে সেইসঙ্গে বাড়ত প্রযুক্তিগত সমস্যাও।
তিন বছর বয়সি কুদরিয়াভকার ওজন পাঁচ কিলো। আকারে সে খুবই ছোট। গায়ের রং সাদা ও বাদামি। তাকে প্রেসের সামনে আনেন সোভিয়েত কর্মকর্তারা। প্রেসমিটে অবলা জীব করে ওঠে 'ঘেউ-ঘেউ'। প্রেসই তার নাম দেয় 'লাইকা'। রাশিয়ান ভাষায় এই শব্দের অর্থ ঘেউ-ঘেউ করা। তখন লাইকা কেবল সোভিয়েত রাশিয়াতেই নয়, আমেরিকাতেও আলোচিত। আমেরিকান প্রেস কুদরিয়াভকার আরও একটি নাম দেয়— মাতনিক। শব্দটি স্পুটনিক নামের অপভ্রংশ।
মিশনের তত্ত্বাবধানকারী বিজ্ঞানী ড. ভ্লাদিমির ইয়াজডভস্কি সোভিয়েত মহাকাশ মিশনের উপর লেখা একটি বইয়ে লাইকার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, লঞ্চের একদিন আগে তিনি লাইকাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। যাতে শেষ কয়েক ঘণ্টা সে আরামে থাকতে পারে। এই সহানুভূতির একটি কারণও ছিল। পৃথিবীতে থাকার সময় ঘনিয়ে এসেছে তার। বিজ্ঞানীরাও জানতেন, কিছু দিনের মধ্যেই মহাকাশে তার মৃত্যু হবে। তাই তার খাদ্যতালিকায় দেওয়া হয় ধীরগতির বিষ। যাতে সে কোনো কষ্ট ছাড়াই শান্তিতে মরতে পারে। অপারেশনের মাধ্যমে লাইকার শরীরে হৃৎস্পন্দন, বিপি ও শ্বাস-প্রশ্বাস মাপার সেন্সর বসানো হয়। পাল্স নির্ণয়ের জন্য একটি ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম বসে। কুকুরের চলাচল শনাক্ত করার উপযোগী যন্ত্রপাতিও বসানো হয় ছোট্ট লাইকার শরীরে।
৩ নভেম্বর ১৯৫৭। লাইকার শরীরে আয়োডিন দ্রবণ প্রয়োগ করা হয়। টেকনিশিয়ান লাইকাকে ঘোড়ার সাজের মতো একটি হার্নেস পরিয়ে তার জন্য তৈরি চেম্বারে বসিয়ে দেন। সন্ধ্যা ৭.২২ মিনিটে রকেটটির টেকঅফ। কয়েক মিনিটের মধ্যে মহাকাশে উড়ে যায় লাইকা। গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে তখন সে জাতীয় বীর। যদিও সোভিয়েত রাশিয়ার বাইরের অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিল। ব্রিটেনের মানুষ এক ঘণ্টা নীরবতা পালন করেন। নভোযানটিতে জীবন ধারণের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা হয়। এতে একটি অক্সিজেন উৎপাদক ছিল। তাছাড়াও ছিল অক্সিজেনকে বিষাক্ত হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা ও কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও। মহাকাশযানে রাখা একটি পাখা কেবিনের তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে বেড়ে গেলেই সক্রিয় হয়ে উঠত। এভাবেই বজায় থাকত কুকুরের সহনীয় তাপমাত্রা। ৭ দিন বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার জেলাটিন হিসেবে সরবরাহ করা হয়েছিল। লাইকাকে আবর্জনা সংগ্রহের জন্য একটি ব্যাগের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। লাইকা যাতে উঠে দাঁড়াতে না পারে, কিংবা হাঁটা বা শোয়ার জন্য সে যেন বেশি নড়াচড়া করতে না পারে, এজন্য ছিল শিকল। এতটাই ছোট সেই কেবিন, যাতে ঘোরার মতো জায়গাও অপ্রতুল।
স্পুটনিক-২ পৃথিবীর চারপাশে ১৬২ দিন ঘুরে ১৯৬৮ সালের ১৪ এপ্রিল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। বায়ুমণ্ডলে সংস্পর্শে আসার পরেই সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয় নভোযান। এর মাত্র কয়েকটি টুকরো মাটিতে পড়ে। স্পুটনিকের পরে আরও কিছু মহাকাশযান লঞ্চ হয়। ১৯৬১-তে রাশিয়া প্রথম মানববাহী মহাকাশ অভিযানে সফল হয়। এসবের নপথ্যে অবলা ওই চারপেয়ে। রাশিয়া জুড়ে লাইকার মূর্তি বসে। বাজারে তার নামের ব্র্যান্ডের সিগারেট পর্যন্ত বের হয়। তার আত্মত্যাগ মহাকাশ প্রযুক্তির অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
তবে জানা যায়, সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা ১০ দিন ধরে লাইকার দেহ থেকে পাওয়া যে তথ্য প্রকাশ করছিলেন, সেসব তথ্য নাকি ভুয়ো। টেকঅফের সময় প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে লাইকার চেম্বারের তাপমাত্রা অনেকটাই বেড়ে যায়। সেন্সর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, তার হৃৎস্পন্দন পৌঁছে যায় প্রতি মিনিটে ২৪০-এ। যা স্বাভাবিকের দ্বিগুণ। চার ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত ডেটা আসা বন্ধ যায়। এর একটাই অর্থ, লাইকা মারা গেছে। মিশনের তত্ত্বাবধানকারী বিজ্ঞানীদের অন্যতম ওলেগ গাজেঙ্কোর বলেন, “আমি লাইকার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত। আসলে, আমরা সেই মিশন থেকে কোনও নির্দিষ্ট তথ্যও পাইনি যাতে লাইকার মৃত্যুকে জাস্টিফাই করা যায়।”
তারপর বহুবার মহাকাশে গেছে মানুষ। চাঁদে রেখে এসেছে পায়ের চিহ্ন। কিন্তু রয়ে গেছে লাইকা-কে নিয়ে রহস্য। পৃথিবীর গণ্ডি অতিক্রম করে প্রথম মহাশূন্যের বুক ছুঁয়ে এসেছে সে। তথ্য আর গল্পের মিশেলে লাইকা আজ কিংবদন্তি।
Powered by Froala Editor