অভিযাত্রী গালওয়ানের নামেই নামকরণ উপত্যকার, নিজেও সাক্ষী ছিলেন চিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের

সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমের পাতায় পাতায় উচ্চারিত হচ্ছে গালওয়ান উপত্যকা এবং নদীর নাম। লাদাখে ভারত-চিন সীমান্তে এই গালওয়ান উপত্যকা ঘিরেই উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সামরিক এবং বাণিজ্যিক এই দুই ক্ষেত্রেই গালওয়ান একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডোর। যার জেরে গত পঞ্চাশ বছরের জঘন্যতম সংঘাতের সম্মুখীনও হয়েছে এই দুই পরমাণু শক্তিধর দেশ। তবে শুধু আজ না এই অঞ্চলের উপর প্রভাববিস্তারের জন্য দ্বন্দ্বের ইতিহাস শতাব্দীপ্রাচীন। সেই ইতিহাসেই লুকিয়ে আছে এই অঞ্চলের নামকরণ-ও।

এই উপত্যকার নামকরণ করা হয়েছিল লাদাখি এক অভিযাত্রী এবং অনুসন্ধানকারী গুলাম রসুল গালওয়ানের নামে। আজ থেকে প্রায় একশো তিরিশ বছর আগে। যখন লাদাখে জটিল হতে শুরু করেছে লাদাখের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। আজ থেকে প্রায় হাজারেরও বেশি বছর আগে থেকেই লাদাখের মধ্য দিয়ে আমদানি-রপ্তানি হত চা, ক্রিম, ঘি, পশম, সিল্ক, লবন, দানা শস্য, নীলের মত পণ্য। সিল্ক রুট হয়ে বণিকদের ক্যারাভ্যান পৌঁছে যেত একদিকে কাশ্মীর কিংবা পাঞ্জাবে; অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য, তিব্বত, মধ্য এশিয়ায়। তাই সিল্করুটের পথে লাখাদ ছিল একটি অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই লাদাখে ক্ষমতাবিস্তারের জন্য শুরু হয় রাজনৈতিক টানাপোড়েন। লাদাখের রয়্যাল নামগাল বংশের রাজাদের হারিয়ে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন কাশ্মীরের রাজা গুলাব সিং। পরবর্তীকালে সেই সাম্রাজ্যও বিকিয়ে যায় ব্রিটিশ শক্তির হাতে। পাশাপাশি চিন এবং রাশিয়াও হাত বাড়ায় লাদাখের দিকে। যদিও লাদাখের অধিকাংশ অংশই তখনো অনাবিষ্কৃত। ফলে শুরু হল দুর্গম অঞ্চলগুলিতে অভিযান, নতুন রাস্তার সন্ধান এবং আধিপত্য স্থাপনের কাজ। শ্রমিক হিসাবে কাজে লাগানো হত লাদাখের অধিবাসীদেরই। চলত লাদাখের বরফে মোড়া ধূসর গ্রামগুলিতে লুঠতরাজ-ও।

এমনই পরিস্থিতিতে ১৮৭৮ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন গুলাম রসুল গালওয়ান। লাদাখের ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলে তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দারিদ্র্য, অধিগ্রহণের ছাপ। পরিবারের আর্থিক অবস্থার সামাল দিতে মাত্র ১২ বছর বয়সেই নামলেন শ্রমিকের কাজে। অফিসার কিংবা বণিকদের মালবহন, পশুর পাল পৌঁছে দেওয়া, অশ্ব-পরিচালক এসবেই হাত লাগালেন তিনি। বদলে কখনো মিলত দু’মুঠো খাবার, কখনো সামান্য অর্থ। 

১৮৯২ সালে একটি ঘটনায় মোড় ঘুরে যায় গুলাম রসুলের জীবনে। সুযোগ আসে পথপ্রদর্শক হয়ে সঙ্গ দেওয়ার একটি ব্রিটিশ দলের অভিযানে। চার্লস মারে এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এক লেফটেন্যান্টের এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল আজকের গালওয়ান নদীর উৎস খুঁজে বের করা এবং সমগ্র অঞ্চলের মানচিত্র তৈরি। তবে তখনো তার নাম গালওয়ান হয়নি। তা কেবল শিয়ক নদীর একটি উপনদী হিসাবেই পরিচিত।

দুর্গম প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং প্রতিকূল আবহাওয়ায় এই অভিযানে নাভিশ্বাস ছুটে গিয়েছিল ব্রিটিশ দলটির। দুরূহ গিরিখাত, সংকীর্ণ উপত্যকায় মোড়া রাস্তা গোলকধাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁদের কাছে। গন্তব্যের থেকে ছিটকে পথ হারায় তাঁদের ক্যারাভ্যান। আকসাই চিনের পাহাড়ি উপত্যকার খাঁজে না ছিল এগোনোর পথ, না ফেরার। ফুরিয়ে আসছিল সঙ্গে আনা খাবারও। তবে হাল ছাড়েননি ১৪ বছর বয়সী ছোট্ট কিশোর গালওয়ান। একক প্রচেষ্টায় খুঁজে বার করেন একটি পথ। যে রাস্তা গিয়ে পৌঁছায় সেই নদীর কাছে। গালওয়ানের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন চার্লস মারে। তাঁর নামেই মানচিত্রে তিনি সেই খরস্রোতা নদীর নামকরণ করেন ‘গালওয়ান নালা’। উপত্যকাটির নাম দেওয়া হয় ‘গালওয়ান ভ্যালি’।

আরও পড়ুন
নিজেদের হেফাজতে থাকা ১০ ভারতীয় সেনাকে মুক্তি দিল চিন

নিজের জীবন কাহিনী ‘সারভেন্ট অফ দ্য সাহিবস’-এ একাধিক অভিযানের সঙ্গেই এই ঘটনার বর্ণনা করেছেন গালওয়ান। গালওয়ান উপত্যকার রাস্তা খুঁজে বার করার পাশাপাশি তিব্বত, ইয়ারকান্ড, পামির, কারাকোরাম এবং আফগানিস্থানের নানান দুর্গম পথ-ও খুঁজে বার করেছিলেন তিনি। সঙ্গ দিয়েছিলেন মার্কিন অভিযাত্রী ব্যারেট, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-নির্মাতা ফ্রান্সিস ইয়ংহাজব্যান্ড, এবং মেজর গডউইন অস্টিনের, যিনি দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কে-২ এর উচ্চতা পরিমাণ করেছিলেন। 

কাশ্মীরি, লাদাখি এবং ভাঙা ইংরাজি তিন ভাষাতেই দক্ষতা থাকার জন্য ব্রিটিশ বাহিনী তাঁকে ‘আকাসাকাল’ বা ব্রিটিশ কমিশনারের চিফ অ্যাসিস্ট্যান্টের পদে বসিয়েছিল। রসুলের বাবা পেয়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর কাজ। তবে খুব বেশি দিন কাটাতে পারেননি শান্তিতে। লাল ফৌজের সঙ্গে একটি যুদ্ধে, চিনের পিএলএ বাহিনীর হাতে বন্দি হন তাঁর বাবা। পরবর্তীকালে তিনি মুক্তি পান। তবে সেই যুদ্ধে প্রাণ গিয়েছিল অনেকেরই। গালওয়ান সাক্ষী ছিলেন সেই ভয়ঙ্কর সংঘর্ষের। ১৯২৫ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে প্রাণ হারিয়েছিলেন গালওয়ান। তবে তাঁর জীবন, নামের সঙ্গেই যেন জুড়ে গেছে রক্তক্ষয়, যুদ্ধের বিভীষিকা। কয়েকদিন আগের ভারত-চিন সংঘর্ষ যেন সেই কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
পদে-পদে নির্ভরশীলতা, চিনা দ্রব্য বয়কট কি আদৌ সম্ভব ভারতের পক্ষে?